অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী #পর্ব_৩১ #জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীর বাবা সকালে বের হতেই একজন ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা তুললেন। সাথে আরো কয়েকজন সঙ্গ দিয়ে মাহমুদের মায়ের কথা তুললেন। আকাশ থেকে পড়লেন যেন তিনি। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ! মেয়ের শাশুড়ীকে নিয়ে এমন নিম্ন মানসিকতার চিন্তাভাবনা মানুষের কোথা থেকে আসে? অবশ্য তরী মাহমুদের বিয়ের ব্যাপার তিনি এখনো খোলাসা করেন নি। শুধু মেয়ের জন্য পাত্র হিসেবে মাহমুদ কেমন হবে, এতটুকুই আলোচনা করেছিলেন পরিচিত কয়েকজনের সাথে। রেগে গেলেন তরীর বাবা। রুক্ষ গলায় বললেন,

-“আজেবাজে কথা বলা থেকে দূরে থাকুন। কে দেয় আপনাদের এমন বুদ্ধি? উনি আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। এখন উনার ছেলের সাথে মেয়ের জন্য সমন্ধ নিয়ে আলোচনা চলছে। সেটা জেনেও কী করে এমন ধরনের কথা বলতে পারেন?”

একজন বললেন
-“আহা! রাগ হচ্ছেন কেন ভাই? মেয়ের বিয়েও দিলেন, সাথে আপনার ঘরও পূর্ণ হলো। তখন মেয়ে শাশুড়ী নয়, মা পাবে। আপনি বরং বড়ো ছেলে পাবেন। আমরা আপনার ভালোর কথা ভেবেই বলছি।”

অতিরিক্ত রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তরীর বাবার। চোখের রং পরিবর্তন হয়ে সফেদ অংশে লালছে আভা দেখা দিল। হুংকার ছাড়লেন তিনি,
-“আমার ভালো আপনাদের ভাবতে বলিনি। নিজের ভালোমন্দ আমি নিজেই বুঝি। বিপদের সময় আপনাদের পাইনা। অথচ মানুষ যখন একটু সুখে থাকতে চায়, সেখানে ব্যাঘাত ঘটাতে তখনই আপনাদের দেখা যায়। উস্কানিতেতো খুবই উস্তাদ আপনারা। আর যদি দোকানপাট, কিংবা বাজার-ঘাটে এই সমস্ত আলোচনা শুনি, তবে মা*ম*লা করতেও আমার দিল কাঁপবে না। নয়তো যার মুখে শুনবো তাকে ধরেই পায়ের জুতা খুলে পে*টা*বো। কিছু বলিনা বলে আস্কারা পেয়ে যাচ্ছেন খুব, তাইনা?”

লোকগুলো কিছুটা দমে গেল। কেটে পড়ার ভঙ্গিতে একজন বলল,
-“আজকাল মানুষের ভালো করতে নেই। থাক বাবা আমাদের দরকার নেই। নিজের জীবন নিয়ে ভেবেই কুল পাই না।”

তরীর বাবা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। সারাদিন ব্যাপারটা নিয়ে মনের মাঝে খচখচানি ভাব ছিলো। যতই হোক তিনি তো জানেন মেয়ের শাশুড়ী হয় আয়েশা সুলতানা। কতটা লজ্জার ব্যাপার। বাসায় এসেই গম্ভীরমুখে বসে রইলেন।

তরী বাবার এই গাম্ভীর্যের কারণ সম্পর্কে অবগত। বিকেলেই ছাদে এক ভাড়াটিয়া আন্টি তাকে বাবার সাথে হওয়া ঘটনা খুলে বললেন। উনার স্বামীও নাকি সেখানে ছিলেন। যদিও সবকিছু শুনেন নি। যতটুকু শুনেছেন ঠিক ততটুকুই স্ত্রীকে এসে বলেছেন। আর সেটাই তরীকে জাননো হলো। একটা কথা এক কান থেকে দুকান তারপর তিন কান পর্যন্ত এসে হুবহু আগের ঘটনা থাকেনা। পরিবর্তন হয়ে যায় অনেকটাই। তরীও সম্পূর্ণ না জেনেই আতঙ্কিত হয়ে আছে। বাবা যদি মান সম্মানের কথা ভেবে তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখা টুকু ও বাদ দিয়ে দেন! তরী পাগল হয়ে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই প্রেম তাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। সে জানে মাহমুদ নিজেও তাকে কতটা ভালোবাসে, যত্ন করে। মাহমুদের ভালোবাসা টুকু গভীর কিন্তু প্রকাশ খুবই কম।

তরী ভয়ে ভয়ে বাবাকে ডাকলো,
-“বাবা!”

-“হু।”
ধ্যান ভাঙা স্বরে সাড়া দিলেন বাবা। চোখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। অতঃপর মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলবি?”

তরী ঢোক গিলে ফের জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”

বাবা তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
-“তেমন কিছু না।”
মাথা থেকে খা*রা*প চিন্তা টুকু দূর করতে আজ নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন। তরী আশ্চর্য হলো! মায়ের মৃত্যুর পর বাবা একদিনের জন্যেও নিজেদের ঘরে পা রাখেন নি। এতগুলো মাস পর আজ পা রাখলেন। ভেতর থেকেও দরজা বন্ধ করে দিলেন। তরী আর ভেতরের দৃশ্যটুকু সম্পর্কে অবগত হতে পারলোনা।

★★★

স্ত্রীর হাতে গড়া প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন তরীর বাবা। চোখের কোনে মেঘ জমেছে। হুটহাট বৃষ্টি নামতে পারে। গলা ভার হয়ে এলো। তিনি আজ ভীষণভাবে উপলব্ধি করলেন, স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন তার কদর বোঝেননি। এখন বোধদয় হলো। রুবিনা নামক নারীটি উনার জীবনে অনেক বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল। কখনো নিজের একরোখা মনোভাবের কারণে স্ত্রীর মতামতের গুরুত্ব পর্যন্ত দিতেন না। এখন বুঝতে পারছেন কতটা ভুল তিনি করেছেন। বাংলায় প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে,” আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না।”

তরীর বাবা আজ সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের দিকটা ভেবে দেখবেন। সত্যিই তো সংসারটা মেয়ে করবে। এখানে তার মতামতের গুরুত্বটাই আসল। পিতামাতার দায়িত্ব হলো কন্যাকে সুপাত্রে দান করা। মাহমুদ খা*রা*প ছেলে নয়। তবুও তিনি আত্মগর্বে মেয়ের মতামতের বিরোধীতা করলেন। কিছুক্ষণ স্ত্রীর কথা ভেবে অশ্রু ঝরালেন। অতঃপর চোখেমুখে পানি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তরীকে ডাকলেন।
-“তটিনী।“

তরী অরুকে নিয়ে ছুটে বাবার কাছে এলো। ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,
-“জি বাবা।”

বাবা স্বাভাবিক গলায় তরীকে সামনের সোফা দেখিয়ে বললেন,
-“এখানে বস। কথা আছে তোর সাথে।”

তরীর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা হঠাৎ কী কথা বলতে চাইছেন! তটস্থ চোখের দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে এলো। ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে বসতেই তিনি মেয়েকে বেশ খানিকক্ষণ অবলোকন করলেন। একটু সময় নিয়ে গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
-“তুই কী চাস?”

তরীর নত মস্তক হুট করেই সোজা হয়ে গেল। বাবার পানে তাকিয়ে রইলো চোখজোড়া। বুঝতে পারলোন সে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কিসের কথা বলছো বাবা?”

বাবা সরাসরি বললেন,
-“মাহমুদের সাথেই থাকতে চাস, না-কি আমাদের সাথে?”

তরীর চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। পানি চিকচিক করছে। কিন্তু জবাব দিলোনা। বাবা তাড়া দিলেন।
-“আমি তোকে কিছু প্রশ্ন করেছি!”

আপনাআপনি নিরব অশ্রু কপোল স্পর্শ করলো। হাতের উল্টো পিঠে দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো তরী। রুদ্ধ হয়ে আসা গলায় বলল,
-“বাবা আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে এভাবে দোটানায় ফেলো না! আমি তোমাদের ও ছাড়তে পারবোনা আর না মাহমুদকে।”

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন,
-“আমি তোকে দেখে দিনদিন অবাক হচ্ছি, তটিনী। আমার ভীরু মেয়েটা দিনদিন সাহসের উচ্চ পযার্য়ে চলে যাচ্ছে। আগের তটিনী হলে কখনোই আমার সামনে কথাটুকু বলতে পারতোনা!”

তরী মাথানিচু করে নিলো। বাবার সামনে এভাবে বলায় লজ্জাও হচ্ছে। কিছু পেতে হলে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। সে না-হয় ভীরুতাকে বিসর্জন দিলো!

বাবা আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উঠে চলে গেলেন। অরু পিটপিট করে তরীকে দেখছে। দুপাশে ঝুলে থাকা লম্বা বিনুনি দুটো পেটের কাছটা স্পর্শ করছে। গোলাপি রঙের ফ্রকে মেয়েটাকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। যখন ঝগড়া করার মুডে থাকে, তখন বেশি আদুরে দেখায়। অরু তরীর চোখের পানি মুছে দিল। নরম স্বরে বলল,
-“কাঁদছো কেন আপু? মাহমুদ ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যাবে, এজন্য?”

তরী অরুর ধারণা বদলাতে দিলোনা। উপরনিচ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। ছোট্ট অরু নাক ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। বড়োদের মতো গম্ভীর হতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আলমারির ভেতর লুকিয়ে রাখবো। মাহমুদ ভাইয়া তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো ‘আপু আলমারির ভেতর নেই’। তখন আর খুঁজে পাবেনা তোমায়।”

তরীর দুঃখের মাঝেও হাসি পেল অরুর কথা শুনে। চেপে রাখলোনা। কান্না চোখেই ফিক করে হেসে ফেললো। অরু উৎফুল্ল হয়ে বলল
-“দেখলে তো, আমার খুউউউব বুদ্ধি।”

অরুর নাক টিপে দিয়ে হেসে তরী বলল,
-“হ্যাঁ, আপনার খুব বুদ্ধি।”

★★★

ভাইয়ের সাথে দেখা হলেও কথা বললেন না তরীর বাবা। তিয়াসের বাবা বিদ্রুপ করেই বললেন,
-“আজকাল সাপের পাঁচ পা দেখেছিস না-কি?
না-কি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিস?”

তরীর বাবা হাসলেন। না দাঁড়িয়ে হেঁটে যেতে যেতেই বললেন,
-“নাহ্, তবে আমার পেছনে লোক লাগানো মানুষ দেখেছি।”

কথাটা তিয়াসের বাবাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন বুঝতে পেরেই তিনি তেতে উঠলেন। পেছন থেকেই উচ্চস্বরে বললেন,
-“বাপ যেমন বে*য়া*দ*ব, ঠিক ছেলে-মেয়েদের ও তেমনই শিক্ষা দিয়েছে।”

তরীর বাবা জবাব দিলেন না। ঠুনকো মানুষ বিবেচনা করে এড়িয়ে গেলেন তিয়াসের বাবাকে। বিপদের সময় পাশে থাকেনা। মেয়েকে বিয়ে দেবেনা জানতেই তিনি দু*শ*ম*ন হয়ে গেলেন। আজ বুঝতে পারলেন তরীকে বিয়ে করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য কী। ভেবেছিলেন হয়তো এমন সহজ সরল মেয়েকে যেভাবে ইচ্ছে চালাতে পারবেন, খাটাতে পারবেন। জীবনে বহু ভুল করেছেন তরীর বাবা। তবে এবার আর ভুল করবেন না।
পরদিন দুপুরেই আয়োশা সুলতানাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ জানালেন।

#চলবে…….

(গরম আর বিদ্যুৎ তো শান্তি দেয়না। আজকের পর্বে আপনাদের শান্তি দিলাম। গঠনমূলক মন্তব্য চাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here