অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী #পর্ব_৩০ #জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাড়ির পরিবেশ থমথমে। দুদিন যাবত বাবা কথা বলছেন না, ঘরে খাচ্ছেন না। তরী উদাসী ভঙ্গিতে বসে রইলো। যতবার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, ঠিক ততবারই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ছোটো থেকেই তো ভালোবাসা দিয়ে এই বাবা নামক মানুষটি বড়ো করে এসেছেন। মাথায় ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন। এখনো তাদের কথা ভেবে লোকজনের বিয়ে নামক উস্কানিমূলক বাক্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। সে কি-না বাবার অনুমতি বিহীন বিয়ে করে নিলো? মাহমুদকে সে যেমন ভালোবাসে, বাবাকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সে কি পারতোনা ভয়ডর কাটিয়ে একটিবার বাবার সাথে কথা বলতে! হয়তো বাবা মেনে যেতেন। একটু নয়, অনেকখানিই কষ্ট করতে হতো তাদের। তরী ভাবতে পারলোনা কিছুই। বাবা আজও না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সাহস করে বাবাকে খেতে বলল তরী। তিনি উপেক্ষা করলেন। যেন কিছুই শুনতে পাননি। এই দুঃসময়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারেন না। তরী অজু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইলো বাবাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আজ তার বোধদয় হল। মুনাজাতে কাঁদল অনেকটা সময়। মায়ের জন্য দোয়া করলো।

-“হে আল্লাহ, আপনি বড়ো দয়ালু। উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমার মতো গুনাহগার বান্দাকে আপনার দরবারে কবুল করুন। সকল কবর বাসীর সাথে সাথে আমার মা’কে ও জান্নাতের উচ্চ মকাম দান করুন। পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করুন। আমার বাবাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুস্থতা দান করুন আল্লাহ। আমার ছোটো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কষ্ট কমিয়ে দিন। দিনরাত মায়ের জন্য তাদের আহাজারিতে আমার অন্তর ফেটে যায়। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছিনা। আমি জানি আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করুন আমায়। হিদায়াত দান করে আপনার পথে চলার তাওফিক দান করুন। আপনি যা জানেন, আমি তা জানিনা আল্লাহ। আপনি জানেন কিসে আমার ভালো আর কিসে মন্দ। আপনার পরিকল্পনা, নিয়ামতের অপেক্ষায় আছি আমি। যতটুকু নিয়ামত দান করেছেন তার জন্য হাজার হাজার শুকরিয়া। যা বলে শেষ করার সাধ্য আমার নেই।”

টপটপ করে চোখের পানিতে কপোল জোড়া ভিজে গেল। এখন একমাত্র ভরসা আল্লাহ। সে বাবাকে যেমন চায়, তেমন স্বামীকেও চায়। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে আছে। নিশ্চিয়ই তিনি যা কিছু করেন, বান্দার ভালোর জন্যই করেন।

★★★

রাত নয়টার পর কলিংবেলের শব্দ হলো। বাবা বাসায় আটটার পরই চলে আসেন। মিঠুও ঘরে। তরী মাথায় কাপড় দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে দরজা খুলে দিল। অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার শব্দ ভান্ডার যেন ফুরিয়ে এসেছে। আয়েশা সুলতানা হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন। সাথে আরও চারজন মানুষ আছে। মাহমুদ সবার পেছনে দাঁড়ানো। ইরা, বড়ো ভাইয়া আর রামিও এসেছে। তরী নিরবতা কাটিয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। নম্র ভাবে ভেতরে আসার আহবান জানালো সবাইকে। বাবা সামনের রুমেই বসা ছিলেন। আয়েশা সুলতানাকে পরিবার সমেত দেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। তবে কিছুই বললেন না। ভাবগতি গাম্ভীর্যপূর্ণ। যেন তিনি ধারণা করে ফেলেছেন আয়েশা সুলতানার আসার উদ্দেশ্যটা কী!

বাবার রাগের ব্যাপারে তরী মাহমুদকে জানিয়েছিল বটে। তবে সে যে হুট করে পরিবার নিয়ে এভাবে চলে আসবে এটা ভাবেনি!

আয়েশা সুলতানা গলা ঝাড়লেন। ভদ্রমহিলা ভদ্রভাবেই কথার শুরু করলেন।

-“কেমন আছেন ভাই সাহেব?”

তরীর বাবার থমথমে চেহারায় জবাব এলো,
-“সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়! আমার বিপদের সময় আপনারা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তাতে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তবে ছেলেমেয়েকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাপোর্ট দিতে পারছিনা।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়েশা সুলতানা। বললেন,
-“আপনার মতো প্রথমে আমিও ব্যাপারটি জানতাম না। যখন জেনেছি তখন সত্যি বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছি। আমি নিজেও ওদের এভাবে বিয়েটাকে সাপোর্ট করিনা। ছেলেমেয়ে দুজন-দুজনকে পছন্দ করে। অথচ আমরা অবিভাবক কেউই অবগত ছিলাম না। তারা দুজনে মিলে আমাদের সাথে খোলাখুলি আলোচনায় বসতে পারতো। তরী আপনার মেয়ে। তাকে সবার চেয়ে আপনি ভালো চিনবেন। আপনার মেয়ে ভীতু প্রকৃতির। তার এই ভীরুতার কারণেই আজ আপনিও কষ্ট পাচ্ছেন। অবশ্য তার ভয় পাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনার মতো কঠোর ব্যক্তিত্বের একজন বাবার কাছে নিজের পছন্দ জাহির করার মতো সৎ সাহস তার ছিলনা। এখন হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম। ভুল তো করেই ফেলেছে। আমরাই বাবা-মা। আমরা ছাড়া আর ওদের বুকে টেনে নেওয়ার মতো কে আছে?”

মেজাজ এমনিতেই দুদিন যাবত খা*রা*প হয়ে আছে। রাগ সামলাতে না পেরে হাঁকিয়ে উঠলেন তরীর বাবা। রুক্ষ গলায় বললেন,
-“তাই বলে এভাবে বাবা মায়ের সম্মান নিয়ে খেলবে? তখন ওর রিং পরানো হয়ে গিয়েছে আর সে বিয়ে করে বসে আছে। আমার সম্মানটা কোথায় গেল ভেবে দেখেছেন?”

উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তরীর বাবা। এতোদিনের সবার উপর জমানো রাগ, অভিমান, কষ্ট একসাথে ঝেড়ে ফেলছেন।
আয়েশা সুলতানা ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েই শান্ত গলায় বোঝালেন,
-”বিয়ের ঠিক করার আগে মেয়ের মতামত চাইলে নিশ্চয়ই আপনার সম্মান খুঁইয়ে যেত না! সন্তানের বিয়েতে যেমন বাবা মায়ের মতামতের প্রয়োজন আছে, তারচেয়ে বেশি মতামত প্রয়োজন সন্তানের। কারণ সংসারটা তার। পুরো একটা জীবনের ব্যাপার। আপনি বাবা। আজ আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। একমাস, দুমাস কিংবা এক বছর পর হলেও মেয়ের জন্য আপনারই মন পুড়বে। আর কারো পুড়বেনা। আপনাদের বিপদের মুহুর্ত টুকু না হয় মনে করুন। তখনও আপনার সন্তানদের কাছে থাকার মতো কেউ ছিলনা। এখনও থাকবেনা। দিন শেষে বাবা সন্তানদের জন্য আর সন্তান বাবার জন্যই আছেন। তাহলে কার উপর এতটা অভিমান জমিয়ে রেখেছেন?”

তরীর চোখে পানি টলমল করছে। মাহমুদ আজ কোন কথা বলছেনা। তার বিবেকহীন কাজের জন্য সে নিজেও লজ্জিত। তাই মাথানিচু করে বসে রইলো। অবশ্য তখন এটা ছাড়া তার মাথায় আর কোন বুদ্ধি কাজ করেনি। ইরা মলিন হেসে বলল,
-“দেখুন না আঙ্কেল, আমার বাবা নেই। তাই আমি জানি বাবা হারানোর ব্যথা কী! আপনি থাকা সত্ত্বেও যখন মেয়েকে পর করে দেবেন, আমার চেয়েও বেশি কষ্ট আপনারা দুজনই পাবেন। কারণ দুজন জীবত থাকা সত্ত্বেও একে অপরের কাছে মৃ*তে*র মতো থাকবেন। এটা কি ভালো হবে? শান্তি পাবেন আপনি? নাকি তরী শান্তিতে থাকবে?”

মাহমুদের বড়ো ভাইও মুখ খুললো,
-“আমার ভাইয়ের মাঝে কি কোন কমতি আছে? আপনার যদি তার কোন কাজ অপছন্দ হয়, তবে সে নিজেকে শুধরে নেবে।
শুধু একটা ভুলের জন্য বাবা-মেয়ে কিংবা ওদের দুজনকে আলাদা করবেন না। আপনার কাছে এই একটাই অনুরোধ।”

তরীর বাবার চেহারার থমথমে ভাব কিছুটা কমে এসেছে। তিনি কিছু একটা ভাবছেন বোঝা যাচ্ছে। রামি ছটফট করছে কখন তরীর বাবার মুখ দিয়ে রাজি শব্দটি শুনবে! তবে বড়োদের মাঝে কোন কথা বলছেনা।

সবাই তরীর বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। তিনিও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“আপনার সময় লাগলে আপনি সময় নিন। আমাদের আপত্তি নেই।”

অগত্যা তরীর বাবা জবাব দিলেন।
-“আমি ভেবে জানাবো আপনাদের।”

সকলের মুখে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা গেল। বাবা তরীর সাথে কথা বললেন।
-“সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর, তটিনী।”

তরীর চোখে আনন্দের অশ্রু। চোখে পানি নিয়ে উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে। পেছন পেছন ইরাও উঠে গেল।
রামি, মিঠু দুজনই ছুটে মিঠির ঘরে গেল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কোলাকুলি করলো দুজন। বাবার ভেবে দেখাকে মিঠু যে করেই হোক হ্যাঁ তে পরিণত করবে। মা যাওয়ার পর এই বোনই তো দ্বিতীয় মা হয়ে তাদের আগলে রেখেছে। রাতে শুয়ে পড়ার পর এই বোনই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মিঠু টের পেলেও ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতো। সেই বোনকে কষ্ট পেতে দেয় কী করে?

★★★

তরীর হাতে হাতে কাজ করতে গিয়ে ইরা বলল,
-“চিন্তা করো না, তরী। তোমাকে আমার জা করে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হবোনা।”

তরী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। আল্লাহ কতটা দয়ালু। তার কাছে চাইলেই সব পাওয়া যায়। বাবা তার সাথে কথা বলেছে, আপাতত এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। ঘন্টা খানেক পূর্বেও যে দুনিয়াকে বিষাক্ত মনে হয়েছে, সেই দুনিয়াকে এখন আনন্দের মেলা, সুখের সমুদ্র মনে হচ্ছে। অল্পতেই নিরাশ হলে হয়না। আল্লাহকে ভরসা করে ধৈর্য ধরলে আল্লাহ তার বান্দাকে নিরাশ করেন না। আপনি আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি দেবেন, যা আপনার জন্য উত্তম। সময় মতো আপনি আপনার পাওনা পেয়ে যাবেন। ধৈর্য হারালে চলবেনা।

সবার রাতের খাবার দুজনে মিলে তৈরি করে নিচ্ছে হাতে হাতে।
অরু মাহমুদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মাহমুদ ইশারায় কাছে ডাকলেও গেল না। উঠে পড়লো মাহমুদ। অরুকে কোলে তুলে নিলো। সে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। মিঠুর কাছে শুনেছে তার আপুকে নাকি মাহমুদ ভাইয়া নিয়ে যাবে। তাই অরু ভীষণ রেগে আছে। মাহমুদ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“অরু পাখির মন খা*রা*প কেন? কেউ বকেছে?”

অরু ফোলা ফোলা গালে থমথমে স্বরে জবাব দিলো,
-“আমার আপুকে তোমায় নিয়ে যেতে দেবো না।”

মাহমুদের বড়ো ভাই অরু গাল টে*নে বলল,
-“আমরা সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবো। আমার দুটো বউ লাগবে। একটা আছে, আরেকটা তুমি হবে। তোমাকে ও বিয়ে করবো।”

অরু গাল থেকে হাত সরিয়ে নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-“তুমি বুড়ো। আমি বুড়োলোক বিয়ে করবোনা।”

হো হো করে হেসে উঠলেন বড়ো ভাইয়া। ওদিকে মিঠু আর রামির বেশ আলাপ চলছে চুপিসারে। একজনও ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না।
সবার রাতের খা*বা*র শেষ হতেই মাহমুদরা বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আজ অরু এখন পর্যন্ত ঘুমায়নি। সবাই বেরিয়ে যেতেই সে দরজা ধরে দাঁড়ালো।

-“যাও বের হও। আমার আপুকেও নিতে দেবোনা। আমিও বুড়োলোক বিয়ে করবোনা।”
বলেই ঠা*স করে সবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল অরু।
বাইরে দাঁড়িয়ে তিন ভাই উচ্চ স্বরে হাসলো।

★★★

অনেকদিন পর তরীর মামা ফোন করেছেন। তরীর বাবা মাহমুদ আর তরীর বিয়ের ব্যাপার নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন। মামা বললেন,
-“বিয়ে যেহেতু করে নিয়েছে তখন আর বাঁধা হয়ে লাভ কী দুলাভাই। তাছাড়া ছেলে অনেকগুলো মাস আপনার চোখের সামনে চলাফেরা করেছে। আপনার নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে ধারণা আছে। সবটা ঠিকঠাক হলে আমার মনে হয়না বাঁধা দিয়ে কোন লাভ হবে। মেয়ে যদি সুখী হয় তখন আপনি নিজেও তৃপ্তি পাবেন।”

শা*লা*র সাথে কথা বলেও বেশ অনেকক্ষণ ভাবলেন তরীর বাবা। পরদিন বাইরে আরো কয়েকজনের সাথে বিষয়টি আলোচনা করলেন। অনেকেই মাহমুদ -তরীর বিয়ের পক্ষেই মতামত দিলেন। কয়েকজন অবশ্য খোঁচা দিতে ছাড়লেন না। কিছু পরনিন্দাকারী, টক্সিক মানুষ না থাকলে কি দুনিয়া চলে!
বাইরে আলোচনা হওয়ায় তিয়াসের বাবার কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছালো। সব ভালোর মাঝে তিনি এক বি*শ্রী কাহিনী রটানোর চেষ্টায় নামলেন। আশেপাশের অনেককেই তরীর বাবার সঙ্গে মাহমুদের মায়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা তুলতে উস্কে দিলেন। ব্যাপারটা কানে আসতেই লজ্জায় টেকা গেলনা। তরীর বাবা আগের মতোই গম্ভীর হয়ে গেলেন।
তরীর মনে পূনরায় আতঙ্ক ভর করলো। তার জীবনের সুখটা পেতে পেতে না আবার হারিয়ে ফেলে!

#চলবে………

গঠনমূলক মন্তব্য পেলে আগামীকাল ও গল্প আসবে। তাছাড়া সবাই গল্প অন্যান্য পেইজ থেকে পড়েন। আমার পেইজে রেসপন্স করেন কম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here