#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_০৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বাতাসের ঝাপটায় সামনের কিছু ছোটো চুল বিরক্ত করছে সুহাকে। বারবার চুলগুলো সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে। রিয়াজ যেন মোক্ষম সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রশ্ন করার। সে আবারও প্রশ্ন করলো,
“জবাব দিলেন না তো! কেন মি*থ্যে বলেছেন আপনি?”
সুহা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলোনা। শান্ত চোখে রিয়াজের দিকে তাকালো। রিয়াজ ভড়কে গেল। সে লক্ষ করলো মেয়েটার শান্ত চোখেও একটা তেজ আছে। সুহা বলল,
“আপনি সব খবর নিয়েছেন আমার সম্পর্কে?”
“অবশ্যই নিয়েছি।”
“তবে আমার কাছ থেকে আর কী জানতে চান? সবটা নিশ্চয়ই আপনার জানা।”
রিয়াজ থতমত খেয়ে গেল। সে একটু বাড়িয়ে বলেছে। সবটা জানেনা সে। আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি বিয়ে করেন নি। কিন্তু কেন করেন নি? পরিবারের সাথেই বা থাকছেন না কেন? আপনার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। যা এই প্রশ্নগুলো করতে আমায় বারবার বাধ্য করছে।”
সুহা তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল,
“এত কৌতুহল কেন আপনার?”
রিয়াজ বলল,
“কৌতুহল তো মানুষেরই থাকে তাই-না? এটা তো আর বন্যপ্রাণীর থাকবে না।”
“কথার মারপ্যাচ ভালোই জানেন। তা আমার সম্পর্কে জেনে আপনার কী লাভ?”
“লাভ বলতে কৌতুহল মেটানো। হয়তো বা কখনো আপনার উপকারেও আসতে পারি। এটা আমার লাভ নয়, আপনারই লাভ হবে।”
সুহা বলল,
“আমার লাভের প্রয়োজন নেই।”
রিয়াজ হু*ম*কি*র স্বরে বলল,
“তাহলে আমি সবাইকে জানিয়ে দেব, আপনি মি*থ্যে পরিচয়ে থাকছেন।”
এতে সুহার কঠিন মুখশ্রী দুর্বল হয়ে এলো। মিঠুর কানে কিছুকিছু কথা পৌঁচাচ্ছে। কথাটি কর্ণগোচর হতেই ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকালো। রিয়াজের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধ*ম*কে উঠলো।
“রিয়াজ এসব কী?”
রিয়াজ দমে গেল। সুহা শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল,
“আপনাদের কৌতুহল মেটাচ্ছি আমি। কিন্তু অনুরোধ করে বলছি, আমার সম্পর্কে কারো সাথে কোন ধরনের আলোচনা করবেন না।”
সুহা এখনও হাত জোড় করে আছে। মিঠু বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ব্যাপার কেউ জানবেনা, আর না আমাদের আপনার ব্যাপারে আরও কিছু জানার ইচ্ছে আছে।”
সুহা স্বস্তি পেল। এবার নিজ থেকেই বলল,
“আমি ছোটোবেলা থেকেই মামা বাড়িতে বড়ো হয়েছি। বাকি কাজিনরা যেমন বড়ো হয়েছে, আমিও তেমনই আদরযত্নে বড়ো হয়েছি। আমি মায়ের গর্ভে থাকাকালীন আমার বাবা মা*রা যান। আমার জন্মের পর মায়ের বিয়ে দিয়ে দেন মামা। মা এলেই আমায় প্রাণভরে আদর করতেন। আমার পড়াশোনাতেও মামা-মামী কখনো বাঁধা দেননি। ভার্সিটিতে আমার সাথে এক ছেলের পরিচয় হয়। সে অবশ্য ভার্সিটির বহিরাগত ছাত্র ছিল। আমি শুধু তার ডাকনাম জানতাম অনিক। এর বাইরে কখনো পুরো নাম জানতে চাইনি। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। আর সেখান থেকেই আমরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। পুরো তিন বছরের সম্পর্কের পর তার পুরো নাম জানলাম। আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়লো। তার চলাফেরা বা কথা বার্তায় কখনো প্রকাশ পায়নি সে হিন্দু ধর্মের। আমরা যেমন সালাম দিয়ে কথা বলি, সেও সালাম দিতো। তার সম্পর্কে জানার পর আমি অনেকটা ভেঙে পড়ি। কথা কা*টা*কা*টি হয় আমাদের মাঝে। পুরো তিনমাস ওঁকে এড়িয়ে চলে পরে আমিও আর থাকতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিলাম দুজন বিয়ে করবো। এদিকে কেউ কারো ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি নয়। আমি যেহেতু বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই মামাকে জানালাম। আমার মামার আবার বড়ো বড়ো হুজুরের সাথে ভালো সম্পর্ক। তিনি আমার দ্বারা কখনো এসব আশা করেননি। ছোটো থেকে যে নৈতিকতায় বড়ো করেছেন তা আমি মুহূর্তেই লঙ্ঘন করলাম। মামা মুখের উপর বলে দিলেন,
“তুই যদি ওই ছেলের জন্য বাড়ি ছেড়ে যাস, তবে কখনোই তোর জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা থাকবে না।”
মামা উপরে উপরে আমাকে হু*ম*কি দিলেও আড়ালে তিনি অনিকের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। যেদিন তাদের অমান্য করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি, সেদিন প্রথমবার মামা আমার গায়ে হাত তুললেন। মা তখন শশুর বাড়ি। মামা মাকে ফোন করে বললেন আমাকে থামাতে। আমি মায়ের কল ধরলাম না। জেদ ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। হাত ফাঁকা ছিলোনা আমার। মামা হাত খরচ দিতেন, আমি টিউশন পড়াতাম। সেসব সম্বল হিসেবে নিয়েই অনিকের সাথে বের হওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। অনিক আমার সাথে দেখা করতে স্টেশন পর্যন্ত আসলো ঠিকই, কিন্তু একেবারে বিদায় জানাতে।
সে তার পরিবারকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি। ধর্মের বাইরে গিয়ে থাকা আমাদের দুজনের জন্যই সম্ভব না। মা-বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করছে জানিয়ে আমাকে বাসায় চলে যেতে বলল। সেখানেই সবটা শেষ হয়ে গেল। আমি ওই মুখ নিয়ে আর কীভাবে বাসায় ফিরতাম? যেই মামা আমায় ছোটো থেকে মানুষ করেছেন, তার মুখে চুনকালি মেখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। ততক্ষণে অনেকেই জেনে গিয়েছে আমি অন্য ধর্মের ছেলের সাথে পালিয়েছি। এরপর বাসায় না গিয়ে অবনির কাছে গিয়ে কিছুদিন ছিলাম। সেখান থেকেই পরে আলাদা বাসায় উঠি। আমার মামা এই শহরেই আছেন। তবুও আমরা দূরের মানুষ হয়ে থাকি। কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি আর। ভালো, সেইফ বাসা পেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। একা একজন মেয়েকে কেউ বাসা দিতে চায়না। আমি বললাম,
“আমি বিবাহিত। বাচ্চা হয়না বলে সংসারে অশা*ন্তি। হাজবেন্ড আলাদা বাসায় রাখতে চায়। হাজবেন্ড প্রবাসী।”
তারা হাজবেন্ডের পাসপোর্টের ছবি দেখতে চাইলো। সেটাও অবনি তাদের কোন আত্মীয়ের পাসপোর্ট মেনেজ করে আমাকে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিল। আমার জীবনে ওর অবদান অনেক বেশি। নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে সে’ই আপনাদের জানিয়েছে!”
মিঠু, রিয়াজ চুপচাপ শুনে গেল। রিয়াজ ভীষণ আশ্চর্য হলেও মিঠু তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলোনা।
রিয়াজ বলল,
“খুব খা*রা*প লাগছে আপনার, তাইনা?”
সুহা মলিন হেসে বলল,
“প্রথম প্রথম খা*রা*প লাগতো এই ভেবে যে, অনিক আমার জন্য পরিবার ছাড়তে পারলোনা। অথচ আমি ছেড়ে দিয়েছি। এখন কষ্ট লাগে এই ভেবে যে, আমি বড্ড বোকামি করে ফেলেছি পরিবার ছেড়ে। সেদিন অনিক ঠিক কাজই করেছে। যদি সেও আমার মতো পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসতো তবে দুজনই নিজেদের ধর্মকে অ*প*মা*ন করে বড়ো ধরনের পা*প কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তাম। কেউই হয়তো সুখী হতাম না। অনিকের প্রতি আমার প্রথম দিকে রা*গ কাজ করলেও এখন মনে হয় ছেলেটা সেদিন ঠিক কাজটাই করেছিল। শুধু একটাই আফসোস বয়ে বেড়াই। আর সেটা হলো পরিবার হা*রা*নো।”
রিয়াজ প্রশ্ন করার পূর্বেই বাসা এসে পড়লো। সুহা মৃদু হেসে বলল,
“আর কোন প্রশ্ন নয়। আমার বাসা এসে গিয়েছে।”
★★★
সেদিনের পর আজ চার দিন অতিক্রম হতে চললো। রামির ফিরে যাওয়ার তারিখ ঘনিয়ে আসছে। অথচ অরুর কোন খবর নেই। সে কাউকেই কিছু জানাচ্ছেনা। তার চিন্তায় চিন্তায় অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে বলে রামির ধারণা। নিজ থেকে অরুকে কল দিতেও কেমন যেন লাগছে। অরু এমনিতেই তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে বসে আছে। কল দিলে না-জানি আরও কী কী ভাববে? সে হয়তো ভাববে রামি তার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। আসলেই ব্যাপারটা সত্যি। তবে সেটা অরু জেনে গেলে খুব খা*রা*প হয়ে যাবে।
অরু তরীর নম্বরে কল দিলো। দু-বোনের কথপোকথন শেষে একটা ছোট্ট ইনফরমেশন পেল। তরী অমিকে বলল,
“অমি, যাও তোমার চাচ্চুকে খেতে ডেকে আনো। দ্রুত গোসল সারতে বলো।”
অরু পরে কথা বলছি বলে লাইন কে*টে দিল।
অমি শরীর দুলাতে দুলাতে রামির ঘরে গিয়ে ঢুকলো। তরী সবার খাবার বাড়ছে।
খাটের উপর ফোন পড়ে থাকতে দেখে অমি হামলে পড়লো গেমস খেলার জন্য। স্ক্রিন অন করে লক দেখলো। সাথে আরও একটি জিনিস দেখা যাচ্ছে। তার খালামনির ছবি। অরু হাস্যজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে এমনই একটা ছবি ওয়ালপেপারে দিয়ে রেখেছে রামি। তখনই আবার অরুর ফোন। অমি ওয়াশরুমের দরজায় আ*ঘা*ত করে জানালো,
“চাচ্চু তোমার ফোন।”
রামি ভেতর থেকেই বলল,
“রেখে দে। আমি আসছি।”
অরু তরীর কল কে*টে সাথে সাথেই রামিকে কল দিল। এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই গোসল থেকে বেরিয়ে ফোন তুলবেনা। অরু একবার কল দিল, যাতে রামি ধরতে না পেরে আফসোস করে “ইশ! কেন ধরতে পারলাম না?”
অরু পরিকল্পনা মোতাবেক কল দেওয়ার পরপরই ফোন সুইচ অফ করে রাখলো।
রামি ধীরেসুস্থে বের হলো। চুল মুছে তোয়ালে মেলে দিয়ে এসেই ফোন হাতে নিলো। অরুর ফোন পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কল ব্যাক করলো। ফোন সুইচ অফ। পরপর কয়েকবার কল দিয়েও অরুকে না পেয়ে সত্যিই রামি আফসোস করলো। “ইশ! সময় মতো কেন কল ধরলাম না?”
ফোন হাতে নিয়ে খেতে বসলো। কখন না-জানি অরু কল দিয়ে বসে। যদি প্রথমবারের মতো এবারও না ধরতে পারে! খেতে বসেও ঠিকমতো খাওয়া যাচ্ছেনা। বুকের ভেতর কী এক যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক হৃৎকম্পন হচ্ছে। রামি অল্প খেয়েই উঠে গেল। আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো অরুর হলের উদ্দেশ্যে।
হলের সামনে খাঁ খাঁ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে রইলো রামি। এখনো সূর্যের তেজ কমেনি। অরুর ফোন এখনও সুইচ অফ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শরীরের সাথে শার্ট লেপ্টে আছে আঁটসাঁট ভাবে। যতটা পরিপাটি হয়ে এসেছিল, এখন ততটাই অগোছালো দেখাচ্ছে তাকে। দারোয়ানকে বলল। অরুকে ডেকে পাঠাতে। তার আত্মীয় এসেছে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও অরু নেমে আসলোনা। হঠাৎ দরজা থেকে রামির নজর পড়লো উপরে। অরুর মতোই দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। সে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রামিকেই দেখছে। রামি চেঁচিয়ে ডাকলো,
“অরু নেমে আয়। আমার এই মুহূর্তে তোর সাথে কথা বলা জরুরী। দুদিন পরই আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে।”
অরু জানালার পাশ থেকে সরে গেল। আশাহত চোখে তাকিয়ে রইলো রামি। অরু আসবেনা। সে জানে এই মেয়ে সোজা কথায় কখনো তাকে কেয়ার করবেনা। নিরাশ হয়ে যখন উত্তপ্ত রোদের মাঝে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, তখনই অরুর ডাক,
“তুমি এখানে কী করছো?”
রামির মনে হল মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামলো। অপলক তাকিয়ে থেকে অনেকদিনের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত সে। অরু অগোছালো, উন্মাদ রামিকে আগাগোড়া দেখলো। তার অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে বলল,
“আমার পড়া আছে। আমি যাচ্ছি।”
অরু চলে গেল। রামি বো*কা*র মতো তাকিয়ে রইলো। নিচে নেমে এসে তার তৃষ্ণা বাড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা। এ অন্যায়, ঘো*র অন্যায়। কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। রামি মানবে না। কিন্ত না মেনেও তো উপায় নেই। ক্ষমতা এখন নারীর হাতে। ভাবে পারা যায়, দাপটদেখিয়ে যাবে।
#চলবে…..
“জবাব দিলেন না তো! কেন মি*থ্যে বলেছেন আপনি?”
সুহা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলোনা। শান্ত চোখে রিয়াজের দিকে তাকালো। রিয়াজ ভড়কে গেল। সে লক্ষ করলো মেয়েটার শান্ত চোখেও একটা তেজ আছে। সুহা বলল,
“আপনি সব খবর নিয়েছেন আমার সম্পর্কে?”
“অবশ্যই নিয়েছি।”
“তবে আমার কাছ থেকে আর কী জানতে চান? সবটা নিশ্চয়ই আপনার জানা।”
রিয়াজ থতমত খেয়ে গেল। সে একটু বাড়িয়ে বলেছে। সবটা জানেনা সে। আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি বিয়ে করেন নি। কিন্তু কেন করেন নি? পরিবারের সাথেই বা থাকছেন না কেন? আপনার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। যা এই প্রশ্নগুলো করতে আমায় বারবার বাধ্য করছে।”
সুহা তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল,
“এত কৌতুহল কেন আপনার?”
রিয়াজ বলল,
“কৌতুহল তো মানুষেরই থাকে তাই-না? এটা তো আর বন্যপ্রাণীর থাকবে না।”
“কথার মারপ্যাচ ভালোই জানেন। তা আমার সম্পর্কে জেনে আপনার কী লাভ?”
“লাভ বলতে কৌতুহল মেটানো। হয়তো বা কখনো আপনার উপকারেও আসতে পারি। এটা আমার লাভ নয়, আপনারই লাভ হবে।”
সুহা বলল,
“আমার লাভের প্রয়োজন নেই।”
রিয়াজ হু*ম*কি*র স্বরে বলল,
“তাহলে আমি সবাইকে জানিয়ে দেব, আপনি মি*থ্যে পরিচয়ে থাকছেন।”
এতে সুহার কঠিন মুখশ্রী দুর্বল হয়ে এলো। মিঠুর কানে কিছুকিছু কথা পৌঁচাচ্ছে। কথাটি কর্ণগোচর হতেই ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকালো। রিয়াজের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধ*ম*কে উঠলো।
“রিয়াজ এসব কী?”
রিয়াজ দমে গেল। সুহা শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল,
“আপনাদের কৌতুহল মেটাচ্ছি আমি। কিন্তু অনুরোধ করে বলছি, আমার সম্পর্কে কারো সাথে কোন ধরনের আলোচনা করবেন না।”
সুহা এখনও হাত জোড় করে আছে। মিঠু বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ব্যাপার কেউ জানবেনা, আর না আমাদের আপনার ব্যাপারে আরও কিছু জানার ইচ্ছে আছে।”
সুহা স্বস্তি পেল। এবার নিজ থেকেই বলল,
“আমি ছোটোবেলা থেকেই মামা বাড়িতে বড়ো হয়েছি। বাকি কাজিনরা যেমন বড়ো হয়েছে, আমিও তেমনই আদরযত্নে বড়ো হয়েছি। আমি মায়ের গর্ভে থাকাকালীন আমার বাবা মা*রা যান। আমার জন্মের পর মায়ের বিয়ে দিয়ে দেন মামা। মা এলেই আমায় প্রাণভরে আদর করতেন। আমার পড়াশোনাতেও মামা-মামী কখনো বাঁধা দেননি। ভার্সিটিতে আমার সাথে এক ছেলের পরিচয় হয়। সে অবশ্য ভার্সিটির বহিরাগত ছাত্র ছিল। আমি শুধু তার ডাকনাম জানতাম অনিক। এর বাইরে কখনো পুরো নাম জানতে চাইনি। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। আর সেখান থেকেই আমরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। পুরো তিন বছরের সম্পর্কের পর তার পুরো নাম জানলাম। আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়লো। তার চলাফেরা বা কথা বার্তায় কখনো প্রকাশ পায়নি সে হিন্দু ধর্মের। আমরা যেমন সালাম দিয়ে কথা বলি, সেও সালাম দিতো। তার সম্পর্কে জানার পর আমি অনেকটা ভেঙে পড়ি। কথা কা*টা*কা*টি হয় আমাদের মাঝে। পুরো তিনমাস ওঁকে এড়িয়ে চলে পরে আমিও আর থাকতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিলাম দুজন বিয়ে করবো। এদিকে কেউ কারো ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি নয়। আমি যেহেতু বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই মামাকে জানালাম। আমার মামার আবার বড়ো বড়ো হুজুরের সাথে ভালো সম্পর্ক। তিনি আমার দ্বারা কখনো এসব আশা করেননি। ছোটো থেকে যে নৈতিকতায় বড়ো করেছেন তা আমি মুহূর্তেই লঙ্ঘন করলাম। মামা মুখের উপর বলে দিলেন,
“তুই যদি ওই ছেলের জন্য বাড়ি ছেড়ে যাস, তবে কখনোই তোর জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা থাকবে না।”
মামা উপরে উপরে আমাকে হু*ম*কি দিলেও আড়ালে তিনি অনিকের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। যেদিন তাদের অমান্য করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি, সেদিন প্রথমবার মামা আমার গায়ে হাত তুললেন। মা তখন শশুর বাড়ি। মামা মাকে ফোন করে বললেন আমাকে থামাতে। আমি মায়ের কল ধরলাম না। জেদ ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। হাত ফাঁকা ছিলোনা আমার। মামা হাত খরচ দিতেন, আমি টিউশন পড়াতাম। সেসব সম্বল হিসেবে নিয়েই অনিকের সাথে বের হওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। অনিক আমার সাথে দেখা করতে স্টেশন পর্যন্ত আসলো ঠিকই, কিন্তু একেবারে বিদায় জানাতে।
সে তার পরিবারকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি। ধর্মের বাইরে গিয়ে থাকা আমাদের দুজনের জন্যই সম্ভব না। মা-বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করছে জানিয়ে আমাকে বাসায় চলে যেতে বলল। সেখানেই সবটা শেষ হয়ে গেল। আমি ওই মুখ নিয়ে আর কীভাবে বাসায় ফিরতাম? যেই মামা আমায় ছোটো থেকে মানুষ করেছেন, তার মুখে চুনকালি মেখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। ততক্ষণে অনেকেই জেনে গিয়েছে আমি অন্য ধর্মের ছেলের সাথে পালিয়েছি। এরপর বাসায় না গিয়ে অবনির কাছে গিয়ে কিছুদিন ছিলাম। সেখান থেকেই পরে আলাদা বাসায় উঠি। আমার মামা এই শহরেই আছেন। তবুও আমরা দূরের মানুষ হয়ে থাকি। কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি আর। ভালো, সেইফ বাসা পেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। একা একজন মেয়েকে কেউ বাসা দিতে চায়না। আমি বললাম,
“আমি বিবাহিত। বাচ্চা হয়না বলে সংসারে অশা*ন্তি। হাজবেন্ড আলাদা বাসায় রাখতে চায়। হাজবেন্ড প্রবাসী।”
তারা হাজবেন্ডের পাসপোর্টের ছবি দেখতে চাইলো। সেটাও অবনি তাদের কোন আত্মীয়ের পাসপোর্ট মেনেজ করে আমাকে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিল। আমার জীবনে ওর অবদান অনেক বেশি। নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে সে’ই আপনাদের জানিয়েছে!”
মিঠু, রিয়াজ চুপচাপ শুনে গেল। রিয়াজ ভীষণ আশ্চর্য হলেও মিঠু তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলোনা।
রিয়াজ বলল,
“খুব খা*রা*প লাগছে আপনার, তাইনা?”
সুহা মলিন হেসে বলল,
“প্রথম প্রথম খা*রা*প লাগতো এই ভেবে যে, অনিক আমার জন্য পরিবার ছাড়তে পারলোনা। অথচ আমি ছেড়ে দিয়েছি। এখন কষ্ট লাগে এই ভেবে যে, আমি বড্ড বোকামি করে ফেলেছি পরিবার ছেড়ে। সেদিন অনিক ঠিক কাজই করেছে। যদি সেও আমার মতো পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসতো তবে দুজনই নিজেদের ধর্মকে অ*প*মা*ন করে বড়ো ধরনের পা*প কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তাম। কেউই হয়তো সুখী হতাম না। অনিকের প্রতি আমার প্রথম দিকে রা*গ কাজ করলেও এখন মনে হয় ছেলেটা সেদিন ঠিক কাজটাই করেছিল। শুধু একটাই আফসোস বয়ে বেড়াই। আর সেটা হলো পরিবার হা*রা*নো।”
রিয়াজ প্রশ্ন করার পূর্বেই বাসা এসে পড়লো। সুহা মৃদু হেসে বলল,
“আর কোন প্রশ্ন নয়। আমার বাসা এসে গিয়েছে।”
★★★
সেদিনের পর আজ চার দিন অতিক্রম হতে চললো। রামির ফিরে যাওয়ার তারিখ ঘনিয়ে আসছে। অথচ অরুর কোন খবর নেই। সে কাউকেই কিছু জানাচ্ছেনা। তার চিন্তায় চিন্তায় অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে বলে রামির ধারণা। নিজ থেকে অরুকে কল দিতেও কেমন যেন লাগছে। অরু এমনিতেই তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে বসে আছে। কল দিলে না-জানি আরও কী কী ভাববে? সে হয়তো ভাববে রামি তার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। আসলেই ব্যাপারটা সত্যি। তবে সেটা অরু জেনে গেলে খুব খা*রা*প হয়ে যাবে।
অরু তরীর নম্বরে কল দিলো। দু-বোনের কথপোকথন শেষে একটা ছোট্ট ইনফরমেশন পেল। তরী অমিকে বলল,
“অমি, যাও তোমার চাচ্চুকে খেতে ডেকে আনো। দ্রুত গোসল সারতে বলো।”
অরু পরে কথা বলছি বলে লাইন কে*টে দিল।
অমি শরীর দুলাতে দুলাতে রামির ঘরে গিয়ে ঢুকলো। তরী সবার খাবার বাড়ছে।
খাটের উপর ফোন পড়ে থাকতে দেখে অমি হামলে পড়লো গেমস খেলার জন্য। স্ক্রিন অন করে লক দেখলো। সাথে আরও একটি জিনিস দেখা যাচ্ছে। তার খালামনির ছবি। অরু হাস্যজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে এমনই একটা ছবি ওয়ালপেপারে দিয়ে রেখেছে রামি। তখনই আবার অরুর ফোন। অমি ওয়াশরুমের দরজায় আ*ঘা*ত করে জানালো,
“চাচ্চু তোমার ফোন।”
রামি ভেতর থেকেই বলল,
“রেখে দে। আমি আসছি।”
অরু তরীর কল কে*টে সাথে সাথেই রামিকে কল দিল। এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই গোসল থেকে বেরিয়ে ফোন তুলবেনা। অরু একবার কল দিল, যাতে রামি ধরতে না পেরে আফসোস করে “ইশ! কেন ধরতে পারলাম না?”
অরু পরিকল্পনা মোতাবেক কল দেওয়ার পরপরই ফোন সুইচ অফ করে রাখলো।
রামি ধীরেসুস্থে বের হলো। চুল মুছে তোয়ালে মেলে দিয়ে এসেই ফোন হাতে নিলো। অরুর ফোন পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কল ব্যাক করলো। ফোন সুইচ অফ। পরপর কয়েকবার কল দিয়েও অরুকে না পেয়ে সত্যিই রামি আফসোস করলো। “ইশ! সময় মতো কেন কল ধরলাম না?”
ফোন হাতে নিয়ে খেতে বসলো। কখন না-জানি অরু কল দিয়ে বসে। যদি প্রথমবারের মতো এবারও না ধরতে পারে! খেতে বসেও ঠিকমতো খাওয়া যাচ্ছেনা। বুকের ভেতর কী এক যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক হৃৎকম্পন হচ্ছে। রামি অল্প খেয়েই উঠে গেল। আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো অরুর হলের উদ্দেশ্যে।
হলের সামনে খাঁ খাঁ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে রইলো রামি। এখনো সূর্যের তেজ কমেনি। অরুর ফোন এখনও সুইচ অফ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শরীরের সাথে শার্ট লেপ্টে আছে আঁটসাঁট ভাবে। যতটা পরিপাটি হয়ে এসেছিল, এখন ততটাই অগোছালো দেখাচ্ছে তাকে। দারোয়ানকে বলল। অরুকে ডেকে পাঠাতে। তার আত্মীয় এসেছে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও অরু নেমে আসলোনা। হঠাৎ দরজা থেকে রামির নজর পড়লো উপরে। অরুর মতোই দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। সে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রামিকেই দেখছে। রামি চেঁচিয়ে ডাকলো,
“অরু নেমে আয়। আমার এই মুহূর্তে তোর সাথে কথা বলা জরুরী। দুদিন পরই আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে।”
অরু জানালার পাশ থেকে সরে গেল। আশাহত চোখে তাকিয়ে রইলো রামি। অরু আসবেনা। সে জানে এই মেয়ে সোজা কথায় কখনো তাকে কেয়ার করবেনা। নিরাশ হয়ে যখন উত্তপ্ত রোদের মাঝে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, তখনই অরুর ডাক,
“তুমি এখানে কী করছো?”
রামির মনে হল মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামলো। অপলক তাকিয়ে থেকে অনেকদিনের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত সে। অরু অগোছালো, উন্মাদ রামিকে আগাগোড়া দেখলো। তার অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে বলল,
“আমার পড়া আছে। আমি যাচ্ছি।”
অরু চলে গেল। রামি বো*কা*র মতো তাকিয়ে রইলো। নিচে নেমে এসে তার তৃষ্ণা বাড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা। এ অন্যায়, ঘো*র অন্যায়। কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। রামি মানবে না। কিন্ত না মেনেও তো উপায় নেই। ক্ষমতা এখন নারীর হাতে। যতভাবে পারা যায়, দাপট দেখিয়ে যাবে।
#চলবে……