অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৫১,৫২

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৫১,৫২
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৫১

আবিরের কাছ থেকে এসে ভেতরে যাওয়ার সময় দাদুর রুমের সামনে দাঁড়ালাম৷ ভেতর থেকে রাফিন ও ঝিলির কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। রাফিন বলছে,
“ঝিলি, চকলেট খাবে?”
“খাবো।”
“নাও।”
ঝিলি বোধহয় নিলো। এরপর রাফিন বললো,
“আমাকে একটু দিবে?”
“নাহ।”
“কেন?”
“আপু বলেছে, বাইরের কাউকে কিছু না দিতে।”
“বাইরের কেউ কিছু দিলে তুমি নাও?”
“নিই তো। আপু বলেছে, বাইরের কেউ কিছু দিলে নিতে।”

রাফিন হো হো করে হাসলো অনেকক্ষণ। হাসতে হাসতেই বললো,
“তুমি কথাটা পুরো উল্টো বুঝেছো। বাইরের কেউ কিছু দিলে নিবে না, বাইরের কাউকে তোমার খাবারের ভাগ দিতে পারো সমস্যা নেই, বুঝলে?”

ঝিলি বুঝলে কিনা কে জানে। সে আপনমনে চকলেট খেতে থাকলো। রাফিন ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি আড়ালে সরে দাঁড়ালাম।

রাফিন যাওয়ার পর দাদুর রুমে গিয়ে দেখি ঝিলির হাতে একগাদা চকোলেট, বিস্কুট আর বাহারি রকমের চিপসের প্যাকেট। পাশেই বড় একটা প্যাকেট৷ প্যাকেটে হরেকরকম ফ্রুটস। ঝিলিকে বললাম,
“এগুলো কে দিয়েছে তোমায়?”
“ভালো ভাইয়া।”
“বাইরের কেউ কিছু দিলে নিতে বারণ করেছিলাম?”
“ও তো ভালো ভাইয়া।”
“ভালো ভাইয়া কি তোমার বাসার কেউ?”
“উঁহু।” দু’পাশে মাথা নাড়ালো ঝিলি।
“তাহলে নিলে কেন?”
“চকলেট আমার ভালো লাগে।”
“ছেলেধরা যখন চকলেট দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবে তখন কি করবে?”
“ওকে ঢিশুম-ঢুশুম মেরে চলে আসবো।”
“তুমি কি আমার মার খেতে চাচ্ছো ঝিলি?”
“উঁহু।”

আমি এবার জোরেই ধমকালাম, “তাহলে কি ধমক?”
ঝিলি ভ্যা করে কেঁদে ফেললো। আমি হাসতে হাসতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
“আচ্ছা, আচ্ছা খাও৷ মার দিবো না, ধমকাবোও না।”
“তাহলে চকলেট কিনে দিতে হবে।”
”এতগুলো চকলেট দিলো না ভাইয়া? আবার আমারও দিতে হবে?”
“এগুলো তো ভালো ভাইয়া দিয়েছে। তুমি কি ভালো ভাইয়া?”
“তাহলে আমি কে?”
“তুমি তো আপু।”
“আমি ভালো না?”
“চকলেট দিলে ভালো।”
“ডাকাত! আচ্ছা বলতো আমাকে ভালো লাগে নাকি ভালো ভাইয়াকে?”
“ভালো ভাইয়াকে আমার বেশি ভালো লাগে তোমাকে একটু কম।”

আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
”তোরে যদি আর আদর করছি। দু’দিন হয়নি এসেছে, এসেই উনি ভালো হয়ে গেলেন?”

এরপর থেকে প্রতিদিনই রাফিন আসতে লাগলো। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত সারাক্ষণই সে দাদু আর বাচ্চাদেরকে সময় দিতে লাগলো। সবাই ভালোই উপভোগ করছে ওর সঙ্গ। ও কাজে বেরোতে চাইলেও জোর করে আটকে রাখছে। এদিকে ও বারবার আসায় আমি ঘরে আটকা পড়লাম। ঘর থেকে বেরুনোর জো নেই। দিনরাত সামনের রুমে বসে রাফিনের সাথে আড্ডা চলতে থাকে ওদের।রাফিনকে পেয়ে যেন দাদুর অসুস্থতাও কমে গেল। তিনিও দিব্যি উঠে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দাদুকে বলি ওকে এত আদর না করতে। এখানে এনে বসিয়ে না রাখতে। আমারও সমস্যা হচ্ছে, কুলসুমেরও। দাদু বুঝেও বোঝে না। রাফিনকে পেয়ে যেন বাচ্চা হয়ে গেছে।

আমি দাদুর সাথে খুব রাগারাগি করি। বোঝাই, ও দাদুরও গায়রে মাহরাম। কিন্তু দাদুর এককথা, ও আমার আদরের নাতি। এই বুড়ো মানুষকে নাকি সে দাদী ছাড়া অন্য কোনো নজরে দেখবে না। সুতরাং, গায়রে মাহরামের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমি দাদুকে বাসা ছেড়ে চলে আসার হুমকি দিলাম। দাদু বললেন, “গেলে যাও, আমরা রান্না করে খেয়ে নেবো।”
রাফিনকে পেয়ে সবাই এত স্বার্থপর কিভাবে হয়ে গেল আমার মাথায় আসছে না। আমি তল্পিতল্পা গুছিয়ে আমাদের বাসায় চলে এলাম। সাথে কুলসুমকেও নিয়ে এলাম। কুলসুম বাদে বাকি সবাই রাফিনের ভক্ত হয়ে গেছে৷ নাকীবসহ সবাই চুটিয়ে সময় কাটাতে লাগলো শান্তি কুঠিরে। রাগে আমার গা জ্বলতে লাগলো৷ আমারই বাড়ি থেকে আমাকেই বের করে দিয়ে এখন চুটিয়ে আড্ডা মারা হচ্ছে?

এদিকে সময় ঘনিয়ে আসতে লাগলো। এরমধ্যেই একদিন বাবা রাফিনকে ধরে নিয়ে এলেন বাজার থেকে। মা তো রাফিনকে পেয়ে মহাখুশি। হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেললেন। আমাকে সাথে নিয়ে নাস্তা তৈরি করলেন। এরপর খাইয়ে দাইয়ে বিদায়বেলায় বললেন, ওর বাবাকে নিয়ে আবার আসতে। ওকে বিদায় দিয়ে বাবা বললেন,
“ফাইয়াজকে আজ অন্যরকম লেগেছে কেন?”
“আমি কি করে বলবো? আমি কি দেখেছি?”
“ওর তো লম্বা দাঁড়ি ছিল। আজ দেখলাম চাপ দাঁড়ি, স্টাইল করে ছাঁটাই করা।”
“কাকে আনতে কাকে এনেছো আল্লাহ ভালো জানেন।”
“আর চুলগুলোও কোঁকড়া। ফাইয়াজের চুল তো খাঁড়া, লম্বা। চুল কোঁকড়া করার মেশিনও বোধহয় বেরিয়েছে আজকাল।”

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, “চুল কোঁকড়া?”
“হুম।”
“হুবুহু রাফিনের মতো দেখতে?”
“রাফিন?”
”আই মিন ফাইয়াজ।”
“ফাইয়াজ-ই তো ছিল। চোখের মণিটা লাল বুঝলি?”
“উফ! বাবা কাকে নিয়ে এসেছো? ওটা রাফিন ছিল না বোধহয়।”
“তুই বারবার রাফিন রাফিন করছিস কেন? ওর নাম তো ফাইয়াজ।”
“ওর নাম ফাইয়াজ রাফিন।”
“তুই কিভাবে জানলি?”
“ওকে আমি আগে থেকে চিনি।”
“চিনিস?”
“হুম। আমাকে ফুফির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল একটা ছেলে, মনে আছে?”
“হ্যাঁ।”
“ঐ ছেলেটাই ফাইয়াজ।”
“আল্লাহু আকবার! কবে থেকে তোরা একে-অপরকে চিনিস। অথচ আমাদের সাথে দেখা হলো কোনো মুলুকে গিয়ে। তা তোরা আগে থেকে পরিচিত হলে কথা বললি না কেন?”
“পরিচিত হলেই কি কথা বলতে হবে নাকি?”

বাবা কিছু বললেন না। রীতিমতো দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেলেন। আগের কথা চাপা পড়ে গেল।
“শুনছো, হৃদি নাকি ফাইয়াজকে আগে থেকে চিনে।”

রাতে নাকীব আমাকে বলে রাফিনকেই বিয়ে করতে। “আপু, সেদিন রাতে রাফিন ভাইয়ার বলা সব কথা আমি শুনে নিয়েছি। এরপর আমার মনে হয়নি রাফিন ভাইয়ার চেয়ে বেস্ট কেউ তোমার জন্য হতে পারে বলে।”
”আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর বাজে বকিস না।”

নাকীব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে গেল। নাকীব যাওয়ার পর বাবা-মা একসাথে দুটো ছবি নিয়ে আসে। দুজনই ঝগড়া বাঁধিয়ে বলে,
“আমারটা পছন্দ করবে, আমারটা।”
“না, আমারটা।” মা বলে।
আমি তখন নামাজে। বুঝলাম না কিছু। দুজনের পছন্দের ছেলেকেই তো বিয়ে করছি৷ এখন আবার আমারটা, তোমারটা করার কি আছে? আর ছবি দেখার-ই বা কি আছে? সরাসরি তো পাত্রই দেখে এলাম। নাকি পাত্রের দু’রকম স্টাইলে তোলা ছবি নিয়েও ওরা ঝগড়া করছে কে জানে?

আমি বলি, “দুজনেই ছবিগুলো উল্টে রেখে যাও। আমি পরে দেখে নিবো।”
নাকীব আবার এসে বলে, “আমিও একটা ছবি রাখলাম আপু।”

আমি ছবিগুলো ভাঁজ করে রাফিনের ডায়েরিতে রেখে দিলাম না দেখেই। দেখার ইচ্ছে নেই। যার সাথেই বিয়ে হোক, তার মুখ আমি বিয়ের পরই দেখবো।

আগামীকাল সকালে খালামণিরা রাফিনদের বাসায় এসে পৌঁছাবে। তারপর বিকেলবেলা আমাকে দেখতে আসবে। বিয়ের আর মাত্র ৬ দিন বাকি। মা-বাবা হুলস্থুল লাগিয়ে দিয়েছে। শান্তি কুঠিরেও বইছে খুশির বন্যা। সবাই মহাখুশি। এতকিছুর ভেতরেও আমি কেন যেন খুশি হতে পারছি না। কোথায় যেন একটা খটকা লেগেই আছে।

আমি প্রতিরাতে ইস্তেখারার সালাত কায়েম করে ঘুমাচ্ছি। ফলাফল সন্তোষজনক। প্রতিদিনই ইতিবাচক স্বপ্ন দেখছি। বিয়েটাতেই আমার জন্য কল্যাণ নিহিত।

পরদিন সকালে রাফিনদের বাসায় এসে পৌঁছালেন খালামণিরা। বিকেলে এলেন আমাদের বাসায়। আমাদের বাসায় তখন জমজমাট আসর। শান্তি কুঠিরের সবাই চলে এসেছে। বাবা রাফিনকে ফোন করে ওর পরিবার নিয়ে আসতে বললেন। মা-ও বললেন খালামণিকে। রাফিন বাদে তানভীর ভাইয়ার পরিবারের সবাই আসে।

আমি জানালা দিয়ে গেইটের দিকে তাকিয়ে আছি। প্রথমে খালামণিরা সবাই ঢুকলো। সবার ঢোকা শেষ হলেও আমি জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার তো কিছু করার নেই আজ। আজ সবকিছু থেকে মুক্তি আমার। বুকের কোণে অজানা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। ব্যাথাটা ঠিক কিসের বুঝতে পারছি না। কার অপেক্ষায় জানালায় চোখ রেখেছি তাও জানি না। আমার হবু বর তো ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছে। অথচ তার দিকে তাকাতেও আমার সংকোচ বোধ হচ্ছে।

হঠাৎ দেখলাম আরও একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে একে একে নামলো একটা পুরো পরিবার। সবার শেষে নামলো রাফিন। নাহ! রাফিন তো নয়। এ তো রাফিনের ডুপ্লিকেট। ওহ মাই আল্লাহ! ও এতদিন পর এখানে কেন? আমার বাসায় ঢুকছে! আশ্চর্য! ওর কি কাজ এখানে? কোনো সিনক্রিয়েট করে বসবে না তো?

আমি দৌড়ে নাকীবের ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। তানভীর ভাইয়া বসে আছে ওর ঘরে। নাকীব আমাকে দেখেছে। ও রুমের বাইরে এলো। আমি ঝটপট ওকে বোঝালাম। ও সামনের রুমে চলে গেল।

নাকীব কিছুক্ষন পর এসে বললো, “সে-ই একটা ঝামেলা লেগে গেছে আপু। ওটা রাফিন ভাইয়া ছিলো না সত্যি। দুই পরিবার একে-অপরকে দেখে তো হতবাক। ওরা নিকটাত্মীয় বুঝলে? পরে রাফিন ভাইয়া এসেছে। ও সবটা ক্লিয়ার করলো এসে। বাট গন্ডগোলটা লাগলো কি করে বুঝলাম না।”
“বাবা লাগিয়েছে। আগের দিন রাফিনের মতো ঐ ছেলেটাকে রাফিন ভেবে নিয়ে এসেছিলো এখানে। ওকেই হয়তো বলেছে আজ আমাদের বাসায় আসতে।”
“হবে হয়তো। বাট আমি একটা কথা বুঝলাম না। যমজ না হয়েও ওরা এতটা মিল কিভাবে?”
“আমি জানি না। তোর ভালো ভাইয়াকে জিজ্ঞেস কর।”
“হুম জিজ্ঞেস করতে হবে।”
“ওরা কেমন আত্মীয়?”
“রাফিন ভাইয়ার কাজিন ছেলেটা। মামাতো ভাই।”

নাকীব যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। হঠাৎ আমার মাথায় বহুদিন আগের ঘটনাটা খেলে গেল।
“নাকীব শোন, তারমানে রাফিন জানে ছেলেটা ওর আত্মীয়, অবশ্যই চিনে আগে থেকে?”
“আরে বললাম না, রাফিন ভাইয়া এসেই তো মিটমাট করলো সবটা।”

তারমানে ও সেদিনও জানতো। ইচ্ছে করে ঝগড়াটা লাগিয়েছিলো। অবশ্য ডায়েরিতেও তো লেখা ছিলো আমি বোকার মতো ওকে বিশ্বাস করেছি। সারপ্রাইজ দেওয়ার বেলায় ওর ভেতরে এক বাইরে আরেক রূপ। এই ব্যাপারটা আমার খুব জঘন্য লাগে। বহুরূপী মানুষ আমি একদম সহ্য করতে পারি না। অনেকদিন আগে রাফিনকে বলা আমার একটা উক্তি মনে পড়ে গেল।
“ভেতরটা তোমার মিষ্টি দিয়ে গড়া,
অথচ বাহিরের রূপটা কি ভীষণ কড়া।”

সেটা শুধুমাত্র আমার জন্য। সারা দুনিয়ার মানুষের চোখের মণি তুমি। সবার সাথে কি সুমিষ্ট ব্যবহার তোমার।

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৫২

বিয়ের তিনদিন আগে রাফিনের বড় আপু ও ছোট আপু এলো আমায় দেখতে। ওরা আগেরদিন আসতে পারেনি তাই। আমার রুমে একা বসে আছি। বাইরে সবাই ব্যস্ত নিজেদের কাজে। আমার বিয়ে, অথচ আমার-ই কোনো মূল্য নেই। রুমে আমাকে সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সাদা আঁচলের আকাশী রংয়ের একটা শাড়ি পরেছি আমি। শাড়িটার ডিজাইন পুরোপুরি আকাশের। পুরো শাড়ি জুড়ে মেঘেদের উড়াউড়ি। আঁচলেও মেঘ, তবে বৃষ্টি নেমেছে। শাড়িটা দেখামাত্রই এত পছন্দ হলো আমার। এটা এসেছে পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে। বড়আপু নিজে শাড়িটা পরিয়ে দিলেন আমায়। শাড়ি পরার পর সাদা রংয়ের হিজাবও পরিয়ে দিলেন। বড়আপুকে যতবার দেখছি ততবার আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। উনি কেন আমার এত যত্ন করছেন? একদম মায়ের মতো! শাড়ি পরানোর পর হালকা সাজিয়েও দিলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন ওনার ছোট্ট তিন বছর বয়সী বাচ্চাটাকে। আপু যাওয়ার পর আমি ওকে কাছে ডাকলাম।
“তোমার নাম কি বাবু?”
“আয়েশা!”
“মা শা আল্লাহ! কত সুন্দর নাম তোমার।”
“তোমাল নাম কি?”

আমি হেসে বললাম, “আমাল নাম আরোহী।”
“তুমি আমাল মামী?”
বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে মুহুর্তেই গা শিরশির করা অনুভূতি বয়ে গেল শরীরজুড়ে। ওর দিকে তাকিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম,
“হু, তোমার মামী।”
“মামা বলেতে তোমাতে মাম্মাম দাকতে।”
“তাই? আচ্ছা তুমি একটু বসো, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

আয়েশাকে রেখেই ওয়াশরুমে চলে গেলাম। কেমন যেন অস্থির লাগছে আমার৷ এমন কেন হচ্ছে? আমি তো এতদিন রাফিনকে ছাড়া দিব্যি ভালো ছিলাম। ওর কথা আমার মনেও পড়তো না। এখন প্রায়ওর কথা মনে পড়ছে। আল্লাহু! বুকটা তো যন্ত্রণায় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা রাফিনের জন্য না, দোটানায় পড়ে হচ্ছে। রাফিনকে সামনে দেখে অজান্তেই আল্লাহর অবাধ্যতা হয়ে যাচ্ছে আমার দ্বারা তাই ভেতরটা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আয়েশাকে একা রেখে এসেছি মনে পড়তেই দরজা খুলে বের হলাম। বের হতেই চোখাচোখি হয়ে গেল রাফিনের সাথে। ও আয়েশাকে নিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে আছে। আয়েশা ওর পেটের ওপর বসে ওকে চিপস খাইয়ে দিচ্ছে। আমি আবার ওয়াশরুমে ঢুকতে পা বাড়ালাম। রাফিন বললো,
“স্যরি! আমি চলে যাচ্ছি। আয়েশা আটকে রেখেছে, আমাকে যেতে দিচ্ছে না। চলো আয়েশা।”
“মামা, আমলা এথানে থাব্বো।”

রাফিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইলাম। ঢুকরে কান্না আসছে আমার। রাফিন কি কিছুই বুঝতে পারছে না? ও কেন বারবার আমার সামনে আসছে? আমি তো নিজেকে সামলাতেই পারছি না। ও কেন আমার সাথে মিলিয়ে পোশাক পরলো? সাদা রংয়ের শার্ট পরে দিব্যি হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ও প্রায়সময়ই সাদা অথবা কালো পোশাক পরে। গলার ভেতর আটকে আসা কান্নাটা চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নামাজ পড়তে পারলে কিছুটা হালকা হওয়া যেত।

রুমে বড় আপুর গলা শোনা গেল।
“কিরে, তুমি এখানে কি করছো?”
“উফ! আপ্পি তোমার মেয়েটা আমার মান-ইজ্জত সব ডোবাবে। ও আমাকে বেরুতেই দিচ্ছে না।” ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো রাফিন।
“যাও, ওকে আমি দেখছি। হৃদিতা কোথায়?”

রাফিন কি বললো শুনলাম না। দরজা লাগানোর শব্দ পেলাম। হয়তো চলে গেছে। ব্যালকনি থেকে বেরুতে যাবো তখনই ফ্লোরে একটা কাগজ পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিলাম। স্পষ্ট বাংলায় লেখা,
“সত্যি করে বলতো, তুমি আমায় ভালোবাসো না?”

চোখমুখ খিঁচে কাগজটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম। এতদিন পর ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে? এমনিতেই নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি আমি তারওপর আবার চিরকুট দেওয়া হচ্ছে। বাসি না কাউকে ভালো। কাউকে ভালোবাসি না। কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বাইরে ফেলে দিলাম। কাগজের টুকরোগুলো হাত থেকে ছাড়তেই নিচে তাকিয়ে দেখি রাফিন ঠিক আমার বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক! জবাব নিশ্চয়ই পেয়েছে। আমি চোখের পানি মুছে চলে আসলাম ওখান থেকে। আর কিছুতেই কষ্ট পাওয়া যাবে না ওর জন্য৷ একজন পরপুরুষের জন্য। একজন পরপুরুষের জন্য কষ্ট পাচ্ছি ভাবতেই নিজের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে আমার।

দুপুরের দিকে শাওন এলো, সাথে সোহাকেও নিয়ে এলো। শাওনকে দেখে আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। সোহার সাথে নয় মাস বয়সী বাচ্চা ছেলে। রিয়াদের বাচ্চা! আমি চমকে শুধু এটুকু বলেছি,
“এতকিছু কবে হয়ে গেল?”
“তুই থেমে আছিস বলে কি পুরো দুনিয়া থেমে যাবে নাকি?”
“আমি থেমে আছি?”
“থেমে নেই? আমরা সবাই সে-ই কবে বিয়ে করেছি। অথচ সবচেয়ে বেশি ইসলাম মানিস তুই। তুই-ই বিয়ে করলি না?”
“পাত্র পাইনি ভালো।”
“এবার পেয়েছিস?”
“হু।” মাথানিচু করে মৃদুস্বরে বললাম।
“তুই খুশি তো এই বিয়েতে?”
“খুশি না হলে তো বিয়ে করছি না।”
“তুই ফাইয়াজকে সামনে রেখে আরেকজনের হয়ে যেতে পারবি?”
“না পারার কি আছে? আমি তো ওকে সেই কবেই ছেড়ে এসেছি। নতুন করে ওর হওয়ার তো কারণ নেই। আর তোদের সবার কথায় বারবার ফাইয়াজ চলে আসে কেন? আমি তো ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবো না, মনে না করতে চাইলেও মনে করিয়ে দিচ্ছিস।” আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে গেলাম। সোহা এসে বলল,
“তুমি ফাইয়াজ ভাইয়ার কথা বলতেই মুখ লুকাচ্ছো কেন? তুমি যদি কনফিডেন্ট থাকতে তাহলে নিশ্চয়ই মুখ লুকাতে না।”
“তোমরা সবাই কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইয়াজ ভাইয়া সম্পর্কে জানাবে বলে এখানে এসেছো? সেরকম ভাবনা নিয়ে আসলে তোমাদের আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না।”
“হৃদি, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“শোন, আমার সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে না চাইলে আমার বিয়ের আগপর্যন্ত কেউ একটাবারও রাফিনের নাম উচ্চারণ করবি না আমার সামনে।”
”আমরা তো ফাইয়াজের নাম উচ্চারণ করছি। তুই একাই তো রাফিন রাফিন করে পাগল হয়ে যাচ্ছিস।”
আমি কটমট করে তাকালাম শাওনের দিকে। ও ঝটপট বললো, “আচ্ছা রে বাবা, করবো না।”

বড়আপু যাওয়ার আগে আমার রুমে এলেন। আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন,
“তুমি এই বিয়েতে মন থেকে রাজি তো?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “শতভাগ রাজি আপু।”
“মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ফাইয়াজ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। মা যখন মারা যাচ্ছিলেন, তখন আমার হাত ধরে বলেছিলেন ফাইয়াজকে দেখে রাখতে। এই একটামাত্র ছেলেকে আমরা খুব বেশি ভালোবাসি। যে-ই ওর সান্নিধ্য পেয়েছে সে-ই ওকে ভালোবেসেছে। আর ও ভালোবেসেছে তোমাকে। তুমি চলে যাওয়ার পর প্রায় প্রতিটা রাত ওকে বিমর্ষ অবস্থায় পেতাম আমি। আমাদের ঘর লাগোয়া ছিল। রুমের মাঝখানে শুধু একটা পর্দা ছিল। আমার ভাইটা ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে গিয়ে প্রতিরাতে দেখতাম ওর চোখ জলে টইটম্বুর। মা মারা যাওয়ার পর ও কতরাত ঘুমায়নি আল্লাহ ভালো জানেন। এরপর সবকিছু ছেড়ে মাদরাসায় চলে যায়। ওখান থেকে ফেরার পর ওকে স্বাভাবিক পাই আমরা। অনেক কষ্ট পেয়েছে ও, অনেক। তুমি ছাড়া কারো জন্য কখনো কেঁদেছে বলে আমার জানা নেই। ওর চোখের জলের কারণ হয়েছো একমাত্র তুমি। ছেলেরা ভালোবাসা, রাগ, অভিমান মেয়েদের মতো প্রকাশ করতে পারে না। ছেলেরা সহজে কারো জন্য কাঁদে না। যার জন্য কাঁদে সে বড় ভাগ্যবান। যে ছেলে কোনো মেয়ের জন্য সরাসরি চোখের জল ফেলতে পারে সে নির্দ্ধিধায় ঐ মেয়েটাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তুমি বড় ভাগ্যবতী, জীবনে এমন কারো সান্নিধ্য পেয়েছো।”

গলায় বিঁধে আসা কান্নাটা কোনোরকমে ঢোক গিলে আটকালাম। বড়আপু চলে যাক একবার। এই ঘরে আমি আর থাকবো না। পালাতে হবে এখান থেকে। সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে।

বড়আপু বললেন, “তুমি ওকে আল্লাহর জন্য ছেড়েছো জানি। আল্লাহ চাইলে সব ভালো হবে। আচ্ছা, ভালো থেকো তাহলে। আজ আসি।” বড়আপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন।

বড়আপু বেরুতেই রাফিনের হাসির শব্দ শোনা গেল। ও তো খুশি, বাকীদের ওর জন্য এত দরদ উতলে পড়ছে কেন? কই, ও তো একবারও এসে বললো না, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই। বাকীসব ফেলে চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। ধুৎ! কিসব ভাবছি। টেবিলে ফুলদানিটা দেখে বহুদিনের পুরোনো ভাঙ্গাভাঙ্গির রোগটা আমার ভেতর ফিরে আসতে চাইলো। ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাফিনরা চলে যাচ্ছে। রাফিন হাসতে হাসতে বড়আপুকে কি যেন বলছে আর বড়আপু ওর পিঠ চাপড়ে আস্তে কথা বলতে বলছেন। সব খুশি যেন উপচে পড়ছে ওর। এদিকে বাকীদের যন্ত্রণায় আমিই টিকতে পারছি না। রাফিনরা চলে যেতেই আমি ব্যাগ নিয়ে সবার অলক্ষ্যে নিচে চলে এলাম। পালাতে হবে এখান থেকে। ততক্ষণে জগতে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ব্যাগ নিয়ে প্রাণপনে ছুটতে থাকলাম। আর একমুহূর্তও এখানে না। চারদিকে রাফিন, রাফিন, রাফিন আর রাফিন। অসহ্য! বিয়েটাও শান্তিতে করতে দিবে না আমায়। এতই রাফিনকে নিয়ে মেতে থাকলে ওর সাথেই বিয়ে ঠিক করতো। কই, সে-কথা তো কেউ বলছে না একবারও। আর ঠিক করলেও বা কি? আমি কখনোই ওকে বিয়ে করবো না, কক্ষনো না। হুহ!

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here