#গল্প১৩৮
#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৬)
১.
সূর্য কয়েকটা দিন ধরেই ভাবছে কী করে কম্পিউটার অপারেটর হুমায়ুন ভাইয়ের কাছে গল্প লেখার কথাটা তোলা যায়। লোকটা এমনিতে ভালো, কিন্তু এই কথাটা উনি কিভাবে নেবেন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সেদিন হঠাৎ করেই সুযোগটা এসে যায়। দুপুরের খাবার খেয়ে এসে দেখে হুমায়ুন ভাই মনোযোগ দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছে, ‘মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য’।
সূর্য সুযোগটা নেয়, আন্তরিক গলায় বলে, ‘এই গল্পটা দারুণ, আপনি আগে পড়েননি?’
হুমায়ুন ভাই বই থেকে চোখ সরিয়ে তাকায়, বলে, ‘তুমি পড়েছ এটা? দাঁড়াও, খবরদার এটার ঘটনা আমাকে কিন্তু আগেই বইল না। গল্পের ইন্টারেস্টিং জায়গায় আছি এখন। সারাদিন তো সময়ই পাই না, এই লাঞ্চ টাইমে একটু পড়ি। কাল রাতে শুরু করছিলাম, শেষ না করে উঠতেই পারছি না। এরা যে কী করে এগুলো লিখে!’
সূর্য এবার আর দেরি করে না, নিচু গলায় বলে, ‘হুমায়ুন ভাই, লাঞ্চের এই সময়টাতে তো কম্পিউটারে কোনো কাজ থাকে না, আমি একটু গল্প লিখতে চাই।’
হুমায়ুন অবাক চোখে সূর্যের দিকে তাকায়, ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী বললা, গল্প লিখবা লাঞ্চের সময়ে? তুমি গল্প লিখতে পারো?’
সূর্য মাথা নাড়ে, বলে, ‘আমি আগে গল্প লিখতাম, অনেকে তো ভালোই বলত। ভাবছি, লেখার অভ্যাসটা অন্তত ঠিক রাখি। এতদিন জেলে থাকলে একসময় তো লেখালেখিটা ভুলেই যাব। তাই আপনি যদি একটু সুযোগ করে দিতেন তাহলে লাঞ্চের ছুটির সময় একটু লেখালেখি করতাম।’
হুমায়ুন এমন আবদার তার পুরো চাকরি জীবনে শুনে নাই, কোনো বন্দি গল্প লিখতে চায়। রাজবন্দিদের লেখালেখি করতে দেখেছে ও, কিন্তু এমন খুনের আসামি যে গল্প লিখে তা আগে দেখে নাই। গলা খাকড়ি দিয়ে বলে, ‘তা না হয় লিখলা, কিন্তু এই গল্প লিখে কী হবে? যদি কেউ নাই পড়ে তো এই গল্পের দাম কী? তুমি তো এই গল্প বাইরে কোথাও পাঠাতেও পারবে না।’
কথাটা ঠিক, ওর লেখা তো কোথাও পাঠানো যাবে না, কেউ দেখবেও না। কিন্তু তাও ও লিখে রাখতে চায়। সূর্য আনমনে বলে, ‘আমি যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাব সেদিন আপনি কষ্ট করে লেখাগুলো আমাকে ইমেইল করে দেবেন। এই লেখাগুলোই আমার সঞ্চয়।’
হুমায়ুনের মাথায় কথাগুলো ঢোকে না, সবাই টাকা জমায়, সাজা শেষ করে জমানো টাকা নিয়ে ফিরে যায়। আর এ বলছে গল্প জমাবে, কী অদ্ভুত! ওর অবশ্য নিজেরও গল্প পড়তে ভালো লাগে, বিশেষ করে ওর নামটা হুমায়ুন আহমেদ হওয়াতে ওর খুব গর্ব হয়। এই নামে একজন বড় মাপের লেখক ছিলেন। মাঝে মাঝে ওরও ইচ্ছে হয় এমন গল্প লিখতে, কিন্তু মাথাটা একদমই ফাঁকা, কোনো প্লটই মাথায় আসে না।
একটু চিন্তা করে হুমায়ুন, তারপর বলে, ‘আচ্ছা লিখতে পারো, কিন্তু শুধু লাঞ্চ টাইমে। আর অন্য কেউ যেন না বোঝে। আমার নামে একটা ফোল্ডার করে তার ভেতরে রেখে দিও।’
লোকটা এত সহজে রাজি হবে সূর্য ভাবতেও পারেনি, একটা মুক্তির পথ যেন ও চোখের সামনে দেখতে পায়। এই বন্দিজীবনে এখন একটা নতুন কিছু নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা যাবে। জীবনের না পাওয়ার কষ্টগুলো অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে থাকা যাবে।
এরপর থেকে সূর্যের দিনগুলো সত্যিই অন্যরকম হয়ে যায়। সারাক্ষণ মনের মাঝে ভাবনারা লুকোচুরি খেলতে থাকে। মনে মনে ভাবনাগুলো জোড়া লাগায়, সাজাতে থাকে গল্পের গল্পগুলো। পারিজাত আসে, সেই মিষ্টি দিনগুলো আবার ফিরে আসে। প্রতিদিন একটু একটু করে লিখে যায়। হুমায়ুন মাঝে মাঝে পড়ে আর অবাক হয়ে ওকে দেখে। একদিন তো বলেই ফেলে, ‘তুমি তো দারুণ লিখো, এই লেখা তো মানুষ পড়লে পাগল হয়ে যাবে।’
সূর্য হাসে, কিছু বলে না। কিন্তু হুমায়ুন ভাইয়ের এই কথাটাও ওকে খুব অনুপ্রাণিত করে। বেঁচে থাকার নতুন একটা মানে খুঁজে পায়। এখন ওর জীবনে একটা উদ্দেশ্য আছে। জেল থেকে বের হয়ে এই গল্পগুলো ও মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। একজন বন্দি, একজন মায়ের আদর থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ, একজন প্রেমিক কী করে এই অসহ্য দিনগুলো পার করেছে তার গল্প ও লিখবে।
দিন শেষে সূর্য যখন নিজের ওয়ার্ডে ফেরে তখন চোখ বুজতেই পুরনো স্মৃতিরা দখল করে নেয়। গল্পের পরের অংশগুলো কী লিখবে তাই মনে মনে গুছিয়ে নেয়। একটা স্মৃতি মনে পড়তেই সূর্যের বুকটা হু হু করে ওঠে। কোনো এক ফাগুনে পারিজাতকে নিয়ে রিক্সায় করে যাচ্ছিল। মাত্রই সন্ধ্যে হয়েছে, বাতাসে শীতের ছোঁয়া তখনো আছে। পারিজাত ওর গা ঘেঁষে বসেছে, মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে। একটা সুন্দর সুতি শাড়িতে ওকে খুব মায়াময় লাগছিল। ঠিক তখন পারিজাত ওর গালে হঠাৎ ঠোঁটটা ছুইয়ে দিয়েই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে লাজুক হাসি হাসতে থাকে। কী যে মিষ্টি ছিল সময়টা, ভালোবাসা এত সুন্দর হয়! এরপর রিকশায় উঠলেই সূর্য অপেক্ষা করত একটা নরম ছোঁয়ার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, পারিজাত, তোমাকে ভুলে থাকার উপায় নেই, ভালোবাসি।
২.
পারিজাত ধৈর্য ধরে কলেজের কারিকুলাম বোর্ডের মিটিংয়ের নোটগুলো নিচ্ছিল। এই কাজটা খুব বিরক্তিকর, স্যাররা মুখে বলে যাচ্ছে আর ওর সেটা বুঝে নিয়ে লিখতে হচ্ছে। নতুন বছরের ছেলেদের হাতে নতুন কারিকুলাম তুলে দিতে হবে। মিটিং শেষে কাজটা যখন পারিজাতকেই দেওয়া হয় তখন ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এত বড় একটা কাজ ও করবে কী করে! অবশ্য একটাই ভরসা, সিনিয়রদের মধ্যে ধ্রুব আছেন। অন্যান্য যারা আছে তারা তো নামমাত্র থাকবে এটা বোঝাই যাচ্ছে। মূল কাজটা ওকেই দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে।
পারিজাতকে উদবিঘ্ন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব আশ্বাসের সুরে বলে, ‘কী, খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন? আমি আছি তো, কোনো চিন্তাই করবেন না। আমাদের একটা নিজস্ব প্রেস আছে, ওরা এ কাজে দক্ষ। আমরা শুধু সফট কপিটা ঠিক করে দেব, বাকিটা ওরা দেখবে।’
কথাটায় খুব ভরসা পায় পারিজাত। এই ক’টা দিনে এটা অন্তত বুঝেছে যে ধ্রুব খুব ভালো মনের একটা মানুষ। এখানে জয়েন করার সময় থেকেই ও কোনো না কোনোভাবে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য করেছে। সেই প্রথম দিন প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে নিয়ে যাওয়া থেকে আজ পর্যন্ত ওকে কোনো না কোনো ভাবে কাছেই পেয়েছে। একটু দুষ্ট আছে, কিন্তু ভালো। অন্তত অন্যান্য কলিগের মতো ও কেন বিয়ে করছে না এটা বলে বলে মাথা খায় না। সবার এক কথা, একটাই কৌতুহল, ‘তুমি এত সুন্দর, কিন্তু বিয়ে করছ না কেন?’ নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে, সবাই তাই ভাবে। আড়েঠাড়ে তাই জানতে চায় সবাই। কিছু কিছু গল্প ওর কানেও আসে। কিন্তু ধ্রুব কখনোই ওকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেনি, তাই ওর সাথে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়।
সেদিন যখন কাজ করছিল তখন পারিজাত বার বার ঘড়ি দেখছিল। তাই দেখে ধ্রুব দুষ্টুমি করে বলে, ‘কী, কারো সাথে দেখা করার তাড়া আছে বুঝি? বার বার ঘড়ি দেখছেন।’
পারিজাত ম্লান হেসে বলে, ‘আসলে কিছু ছাত্র আমার কাছে ইংরেজিটা পড়ে। ওদের আজ আসার কথা, বাসায় যেতে হতো। কিন্তু এদিকে কাজটাও তো শেষ হয়নি।’
ধ্রুব সাথে সাথে দায়িত্ব নিয়ে বলে, ‘আগে বলবেন তো। আপনি চলে যান, বাকিটা আমি দেখব।’
ধ্রুবর এই দিকটা খুব ভালো লাগে, অন্য কেউ হলে ওর ইংরেজি ব্যাচ পড়ানো নিয়ে হিংসে করত। অনেকেই করে। কেন জানি কলেজের বেশিরভাগ ছাত্রই ওর কাছে পড়তে চায়। পারিজাতও না করেনি। সপ্তাহে তিনটে ব্যাচ ও পড়ায়। এতে অবশ্য অনেকটা সময় চলে যায় ওর। কিন্তু এটাই ওর ভালো লাগে, ব্যস্ত থাকতে চায়। সবাই বলে, ওরা এত ধনী তাও কেন এত কষ্ট করে। পারিজাত শুধু শুনে যায়, কিন্তু আসল কথাটা কাউকে শেয়ার করতে পারে না। ওর যে একটা প্ল্যান আছে, আর সেটার জন্যই টাকা জমাতে হবে অনেক।
পারিজাত ধ্রুবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসে।
রাতে যখন পড়ানো শেষ হয় তখন ওর শরীর অবসন্ন, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। অল্প একটু খেয়ে শুয়ে পড়ে। ইদানীং মা বাবার সাথে কথা কম হয়, একটা অদৃশ্য লড়াই চলছে। বাবা তার জাল বিছিয়ে রেখেছেন যাতে ও কখনো সূর্যের খোঁজটা না পায়। পারিজাতের আফসোস হয়, সূর্যের বাসার ঠিকানাটা ওর মনে নেই। শুধু মনে আছে মিরপুর দশ নাম্বারে কোথাও থাকে। এখন আফসোস হচ্ছে, ঠিকানাটা থাকলে ও সূর্যের মায়ের কাছে যেত, মানুষটা একা একা কেমন আছে? সব মিলিয়ে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। ওর জন্য সূর্যের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল, ওদের পরিবারটা একটা অনিশ্চয়তার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। পারিজাত কী পারবে সব আগের মতো ঠিক করে দিতে? সূর্যকে কী খুঁজে পাবে?
ভাবতে ভাবতে চোখটা মেলে, ঘুম আসছে না। মোবাইলটা খুলে নোটিফিকেশনগুলো চেক করে। আজকাল ফেসবুকে খুব কম সময় কাটায় ও। একটা সময় এখানেই পড়ে থাকত, সূর্যের নতুন নতুন গল্প আসত ‘গল্প পড়ি’ গ্রুপে। প্রতিটা গল্প দারুণ লিখত। অনেক পাঠক ছিল ওর, সবাই খুব প্রশংসা করত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারিজাত কী মনে করে ‘গল্প পড়ি’ গ্রুপটাতে ঢোকে। আনমনে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটা গল্পে চোখ পড়ে যায়, গল্পটার নামটা দেখে ও আধশোয়া থেকে উঠে বসে। চোখটা কচলে গল্পের নামটা পড়ে ‘সূর্যের পারিজাত’।
নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়, দ্রুত ও লেখকের নামটা খেয়াল করে, হুমায়ুন আহমেদ নামে একটা লোক। হতাশ হয় পারিজাত, মনটা এক মুহুর্তে সূর্যের কাছে চলে গিয়েছিল। কী করে মিলে গেল গল্পের নামটা? কী সুন্দর করে ওর আর সূর্যের নামটা জুড়ে দিয়ে গল্পের নামটা রেখেছে!
কী মনে হতে গল্পটা পড়া শুরু করে। পড়তে পড়তে কখন যে ওর চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছে। এই লেখার ধরনটা ওর পরিচিত, আর যে গল্পটা শুরু হয়েছে তা সূর্যের জীবনের প্রথম দিককার কথা। যেটা ও শুনেছে ওর কাছ থেকে। বাবা মারা যাবার পর কী করে একজন মা জীবন যুদ্ধে লড়ে যান একমাত্র সন্তানকে মানুষ করতে। গল্পের নায়কের একটা স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাওয়া। এ যে সূর্যের জীবনের গল্প!
পারিজাত এই লেখকের আর গল্পগুলো খুঁজে দেখে, নাহ, এটাই লেখকের প্রথম গল্পের প্রথম পর্ব। এর আগে উনি কোনো গল্প লিখেনি। এটা কী করে সম্ভব?
পারিজাত চিন্তিত মুখে ভাবতে থাকে, এই লোকটা কে? হুবহু সূর্যের মতো লেখে, আবার সূর্যের জীবনের কথা সে জানে। এ কী সূর্যের কোনো কাছের বন্ধু? কিন্তু লেখার স্টাইল? সেটা কী কেউ এমন অবিকল নকল করতে পারে?
পারিজাতের কেমন যেন শীত শীত লাগতে থাকে। মনের কোণে একটা অসম্ভব ভাবনা খেলে যায়, সূর্য লিখছে না তো? কিন্তু ও তো কারাগারে বন্দি, ও লিখবে কী করে? আর সেটা এই গল্পের গ্রুপে পোস্ট করবে কী করে? নাহ, একটা অস্থিরতা ওকে ঘিরে ধরে। এই লেখকের আগামী পর্বগুলো পড়তে হবে। জানতে হবে আসলে কী গল্পটা কাকতাল না কি ও যা ভাবছে তাই?
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৩/০২/২০২২