টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০৬,০৭

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০৬,০৭
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৬

১৯৪২ সালের শেষের দিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল একবার বাংলায় আসেন ছেলে জনসন চার্চিলের খুঁজে। যদিও জনসন তাঁর ছেলে এটা কেউ জানতো না, উইনস্টনও পরিচয়টা গোপন রাখেন। তাঁর একজন প্রিয় এবং সাহসী সৈনিক হিসেবেই তিনি জনসনের খোঁজ চালিয়ে যান। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। জনসনের খোঁজ তিনি পাননি। শেষে যে ক্যাম্পে জনসন থাকতো তার আশেপাশের আরও দশটি গ্রামে উইন্সটনের নির্দেশে হামলা চালায় ব্রিটিশ সেনারা। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, লোকজনকে ধরে পশুর মতো হত্যা করে। কয়েকদিন ধরে চলে এই হত্যাযজ্ঞ। তবুও যখন কেউ জনসনের খোঁজ দিলো না, উইনস্টন তখন ভিন্ন পথ বেছে নেয়। যে জনসনের খোঁজ দিতে পারবে তাঁকে বিশ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীতে ফলাফল হলো শূন্য। জনসনের খোঁজ আর মেলেনি। সেই সময় জনসনের অধ্যায়টাও মুছে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে আবারও জনসনের ব্যাপারটা বড়ো ইস্যু হয়ে যায়। যুক্তরাজ্যের বড়ো বড়ো পত্রিকাগুলোতে সংবাদ হয় এ ব্যাপারে। যে জনসনের কঙ্কালের খোঁজ দিতে পারবে তাকে বিশ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং পুরস্কার দেয়া হবে। বাংলাদেশের কিছু পত্রিকায়ও নিউজটা আসে। কিন্তু সবাই হেসে উড়িয়ে দেয় নিউজটা। ১৯৪২ সালের একটা লাশের কঙ্কাল খুঁজতে কেউ এত টাকা পুরস্কার দেয়? যে নিউজটা ছড়িয়েছে, নিশ্চয়ই সে পাগল, নয়তো উন্মাদ। নিউজটা একসময় এসে পড়ে একজন খ্যাতিমান ব্যাবসায়ী রাহাত খানের নজরে। অন্য সবার মতো তুচ্ছ বিষয় ভেবে সে উড়িয়ে দেয়নি নিউজটা। এমন একটা লাশের কথা সে শুনেছে। একটা বড়ো বিলের মাঝখানে সে সময় লাশটা পুঁতে ফেলা হয়। কিন্তু বিলের ঠিক কোন জায়গা সেটা সে জানে না। রাহাত ভাবতে থাকে কী করা যায়। তারপর পরিকল্পনায় লেগে যায়। তার হাতে ওই সময় একটা প্রজেক্ট ছিল। প্রজেক্টটা সম্পন্ন করতে সে একটা জায়গার খোঁজ করছিল। খোঁজ নিয়ে দেখলো, যে বিলটাতে জনসনকে পুঁতে ফেলা হয়, বিলটা এখনও খালি আছে আবাদি জমি হিসেবে। জমিগুলোর মালিক যারা তাদের সাথে যোগাযোগ করে রাহাত। তারপর বেশি দাম দিয়ে লিজ নিয়ে নেয়।

অনেকক্ষণ পত্রিকাটার দিকে চেয়ে থাকে রাহাত। তারপর হঠাৎ রেগে উঠে পাশে তার বেতনভুক্ত একজনকে বলে, ‘তুমি বুঝতে পারছো সামিদ, এই লোকটা আমার কত বড়ো ক্ষতি করতে যাচ্ছে? আজ অনেকদিন ধরে আমি এই পত্রিকাটা সাথে নিয়ে ঘুরছি। লাশটার সন্ধান পেলেই যাতে ওদের সাথে যোগাযোগ করে পুরস্কারটা নিতে পারি। লাশটা খোঁজার জন্যই শুধুমাত্র আমি আমার এতবড়ো একটা প্রজেক্টের কাজ শুরু করি শহরের সাইড থেকে দূরের একটা জায়গায়। এই লোকটা আমার অনেক বড়ো ক্ষতি করে ফেলবে। যেভাবেই হোক কঙ্কালটা উদ্ধার করো ওর কাছ থেকে।’

সামিদ এক হাতে পিস্তল ধরে দাঁড়িয়ে রাহাতের কথা শুনছিল। রাহাতের ডানহাত বলা যায় তাকে। তার সব অপকর্ম পরিচালনা করে এই সামিদ। রাহাত থামতেই সামিদ বলে উঠলো, ‘বস, আপনি চিন্তা করবেন না, লোকটা তো এখন আমাদের হাতে বন্দী। কঙ্কালটাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাবো।’

‘তাই যেন হয় সামিদ। যাও, লোকটার কাছে যাও। কথা বের করো মুখ থেকে।’

‘জি বস।’ সামিদ পিস্তল হাতে এগিয়ে গেল বন্দীর কক্ষে। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বাললো সে। রিহান মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। সামিদ তার সামনে গিয়ে কপালে পিস্তল তাক করলো। রুক্ষ কণ্ঠে বললো, ‘কঙ্কালটা কোথায় বলে দাও, আমাদের হাতে তুলে দাও ওটা। প্রাণটা অন্তত বেঁচে যাবে।’

রিহান হাসলো। ‘ওটা তোমাদের হাতে তুলে দিলে যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে তার নিশ্চয়তা কী? বরং, এখন আমি নিরাপদে আছি। আমি বুঝে গেছি, যতদিন কঙ্কালটা তোমরা পাবে না, আমার কিছুই করবে না।’

সামিদ জোরে ঘুষি মারলো রিহানের মুখে। তখন রাহাত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘নু নু সামিদ, মেরো না এখন। কথার মাধ্যমে আলোচনা করে বের করো কঙ্কালটা।’

রিহান বলে উঠলো, ‘আমি না চাইলে কখনও তোমরা ওটা পাবে না। তবে তোমরা আমাকে একটা প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিলে, সহজেই পেয়ে যাবে ওটা।’

‘কী প্রশ্ন?’ আগ্রহ নিয়ে তাকাল রাহাত।

‘সুফিয়া কোথায়? সে কি বেঁচে আছে?’

‘কোন সুফিয়া? আমি কোনো সুফিয়াকে চিনি না।’

‘দুইশো কোটি টাকার চেয়েও বেশি কিন্তু কঙ্কালটার দাম। ঠিকঠাক আমার প্রশ্নের জবাব না পেলে তোমরাও পুরো টাকাটা হারাবে। ভেবে দেখো।’

রাহাতকে কয়েক মুহূর্ত ভাবতে দেখা গেল। তারপর সে বললো, ‘বেশ, আমি আপনাকে সুফিয়ার সন্ধান দেবো। কিন্তু, তার আগে আমাকে কঙ্কালটার সন্ধান দিন।

‘আগে সুফিয়া।’

‘কিন্তু আপনি কি মনে করেন এত বছর পরেও সে বেঁচে আছে?’

‘রিহান চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। তারপর নিজেকে সামলিয়ে বললো, ‘ওর কবরের সন্ধানটা দিলেও হবে।’

‘হ্যাঁ, ওটা দিতে পারি।’

‘তবে আমার বাঁধন খুলে ফেলা হোক?’

সামিদকে ইশারা করলো রাহাত। সামিদ রিহানের বাঁধন খুলে দিলো। বাঁধনমুক্ত হয়ে রিহান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মাথাটা টনটন করে ওঠলো। মাথায় আঘাতের ব্যথাটা জোরালো হয়ে ওঠলো হঠাৎ। মাথায় হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে সে রাহাতের উদ্দেশ্যে বললো, ‘চলুন…’

একটা কবরস্থানে এলো ওরা। ওখানে একটা কবরকে ইশারা করে রাহাত বললো, ‘ওটাই আপনার সুফিয়ার কবর।’

রিহান এগিয়ে গেল কবরটার দিকে। একটা জীর্ণ কবর। অনেকদিনের অযত্নে লতাপাতায় ঢেকে গেছে। কবরটার পাশে বসে পড়লো রিহান। অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাইলো সে ভেতরের মানুষটাকে। ভাবতেই পারছে না সে, সুফিয়া এর ভেতর শুয়ে আছে। হয়তো অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছে মেয়েটা। রিহানের জন্য অপেক্ষা করেছিল। শেষ দেখা হলো না আর দুজনের। রিহান উঠে দাঁড়ালো। রাহাতের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ধন্যবাদ ভাই। আমার অনেক বড়ো উপকার করলে। তাও তো সুফিয়ার কবরটা দেখতে পেলাম। কিন্তু আমাকে বলো তো, তুমি তাকে কীভাবে চিনো?’

‘আমি তাঁকে একটা পাগল হিসেবেই চিনি। প্রায় তাকে রাস্তায় দেখতাম। একদিন রাস্তায় দেখে আমার মায়া হয়। বৃদ্ধা একটা মহিলা, বয়সের ভারে হাঁটতেও পারে না। কাছে গিয়ে কিছু খাবার দিই আমি তাঁকে। তারপর গল্প করি। জানেন তিনি আমাকে প্রথমেই কী বলেন?’

‘কী’

‘তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন আপনার ব্যাপারে। বলে, আমার রিহানকে দেখছো? আমি অবাক হয়ে রিহান কে জিজ্ঞেস করলে, তিনি সবকিছু বলে দেন। আপনাদের পুরো ঘটনাটা। তারপর একদিন ফুটপাতেই দেখি তিনি মরে পড়ে আছেন।’

রিহান চুপ করে শুনলো রাহাতের কথা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘বেশ, তুমি তোমার কথা রেখেছো। আমিও আমার কথা রাখবো। কাল এখানেই আমি কঙ্কালটা নিয়ে আসবো।’

‘এখানে নয়। সামিদ যাবে আপনার সাথে আজ। আজকেই ওর হাতে তুলে দিন কঙ্কালটা।’

‘তবে তাই হোক।’

রিহান অবশেষে কঙ্কালটা সামিদের হাতে তুলে দিলো। রিহান বুঝতে পারলো, সামিদ রাহাতের বেশ বিশ্বস্ত লোক। নয়তো এতো দামি জিনিসটার জন্য সামিদকে পাঠাতো না। কঙ্কালটা নিয়ে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে সামিদ বললো, ‘বস বলেছে আপনাকে সাবধানে থাকতে। কারণ, আপনার পেছনে পুলিশ তাড়া করছে।’

‘সতর্ক করার জন্য ধন্যবাদ।’ ম্লান হাসলো রিহান। সামিদ চলে গেল। রিহান তখন ফোন দিলো ইউসুফ সাহেবকে। ইউসুফ সাহেব ফোন রিসিভ করেই উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘রিহান তুমি কোথায়? কী অবস্থা তোমার? গতকাল থেকেই তোমার ফোনে কল করে পাচ্ছি না তোমাকে।’

‘স্যার, আপনি আমার সাথে একটু এখনই দেখা করতে পারবেন?’

‘ঠিক আছে, তুমি ঠিকানা দাও। আমি আসছি।’

রিহান ঠিকানা দিলো।

একঘণ্টা পর ইউসুফ সাহেবের সাথে রিহানের দেখা হলো। ইউসুফ সাহেবের গাড়িতে বসেই দুজনের কথা চলছিল। রিহান প্রথমেই বলে উঠলো, ‘স্যার, আপনি এমনটা কেন করলেন?’

‘কী করলাম?’ অবাক হলেন ইউসুফ সাহেব।

‘সাইকোলজিস্টের ঠিকানাটা তো আপনিই দিয়েছিলেন। আমিই আপনার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম একজন সাইকোলজিস্টের ব্যাপারে, আর আপনি এমন একজনের কাছে পাঠালেন যে আমাকে একেবারেই পাগল করে দিতে চেয়েছিল ইনজেকশন দিয়ে।’

‘আমি এতকিছু হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি আসলে। পরে তো তোমাকে ওই ডাক্তারের হাত থেকে আমিই রক্ষা করি। তোমার তখন স্বাভাবিক জ্ঞান ছিল না। রাস্তায় টলতেছিলে। আমিই লোক পাঠিয়ে তোমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসি। পরে তোমার বাড়িতে রেখে আসি।’

‘আপনি কীভাবে জানলেন?’

‘শান্তা বলেছে। যে মেয়েটা তোমাকে ক্লিনিক থেকে বের করে এনেছিল। ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল সবসময়। আমার পরিচিত।’

‘স্যার, আপনি আর কত রূপ দেখাবেন নিজের? এই আমাকে মারতে চান, এই আবার বাঁচান। কেন স্যার, কী দোষ করেছি আপনার?’

‘কী বলছো এসব? আমি কেন মারতে চাইবো তোমাকে?’

‘তবে চট্টগ্রামে কেন লোক পাঠিয়েছিলেন আমাকে মারতে?’

ইউসুফ সাহেব এবার থমকে গেলেন। রিহানের দিকে অসহায়ভাবে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই পাঠিয়েছিলাম লোকগুলোকে। তোমাকে মারতে। কিন্তু, চট্টগ্রাম থেকে তো ফেরার পর আর তো কোনো আক্রমণ হয়নি তোমার উপর, তাই না?’

‘কিন্তু, ওইসময় কেন আমাকে মারতে চাইলেন। কী এমন ক্ষতি করে ফেললাম আপনার?’

‘ওই সময় আমি তোমাকে মারতে লোক পাঠাইনি। আমি আমার নিজের অস্তিত্বটা পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে তোমার পেছনে লোক পাঠিয়েছিলাম।’

‘মানে?’ অবাক হলো রিহান।

‘মানে ওই সময় তুমি অতীতে যেতে না পারলে আমারও জন্ম হতো না। আর এই অভিশপ্ত জীবনটাও আমাকে বয়ে এতদূর আনতে হতো না।’ চিৎকার করে ওঠলো ইউসুফ সাহেব। তারপর হু হু করে কেঁদে ওঠলো। রিহান অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ইউসুফ সাহেবের দিকে।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৭

‘মানে? কী বলছেন স্যার? আপনিই কি তবে আমার সেই…’ রিহান কথাটা শেষ করতে পারলো না। ইউসুফ সাহেব চোখ মুছে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সেই ছেলে, যাকে তুমি আমার মায়ের পেটে দেখে এসেছিলে। কিন্তু আমাদের এমন একটা সম্পর্ক যা পৃথিবীর সবার সামনে প্রকাশ করার মতো না। ছেলের বয়স বাবার চেয়ে প্রায় পয়তাল্লিশ বছর বেশি। কে বিশ্বাস করবে। হাসবে লোকে। তাই আমরা এখন যেভাবে আছি, আমাদের সেভাবেই থাকা উচিত।’

রিহানের জন্য এটা একটা বড়ো সারপ্রাইজ। কী করবে সে বুঝতে পারছে না। ওই সময় সুফিয়ার পেটের দিকে তাকিয়ে সে তৃপ্তি পেত। উদগ্রীব হয়ে থাকতো কবে তার সন্তানটা জন্ম নেবে, তাকে বাবা ডাকবে। সে তার ছোট্ট বাচ্চার ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো নিয়ে খেলবে, আদর করবে, আরও কত কী। কিছুই হলো না। অবশেষে নিজের সেই ছেলেকে দেখতে পেল বৃদ্ধরূপে। রিহানের এখন কী করা উচিত? ছেলে বলে জড়িয়ে ধরবে সেই টানটুকুও ভেতর থেকে আসছে না। হয়তো একটা দূরত্বের কারণে এমন হচ্ছে। রিহানকে চুপ থাকতে দেখে ইউসুফ সাহেব পুনরায় বলতে লাগলেন, ‘মায়ের কাছে আমি সব শুনেছিলাম। কীভাবে আমার বাবা অতীতে গিয়ে তাকে বিয়ে করে। তার কাছেই শুনেছিলাম, তুমি চট্টগ্রাম একটা কাজে গিয়েছিলে। তারপর ওখান থেকেই একদিন হুট করে অতীতে চলে যাও। যেদিন অফিস থেকে তুমি প্রজেক্টের ব্যাপারে চট্টগ্রাম যেতে চাইলে, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখনই মাথায় আসে তুমি চট্টগ্রাম যেতে না পারলে হয়তো অতীতেও যেতে পারবে না। তাই আমি খুব করে চেয়েছিলাম তুমি যাতে প্রজেক্ট থেকে সরে যাও। কিন্তু আমার কোম্পানির সিলেকশন কমিটি তোমাকেই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ভেবেছিল প্রজেক্টটার জন্য। তাদের চোখে সন্দেহের কারণ না হতে আমিও মত দিই তোমাকে চট্টগ্রাম পাঠাতে। কী অদ্ভুত তাই না? তোমার অতীতে যাওয়ার পেছনে আমারও হাত আছে। আমিই যেন তোমাকে পরোক্ষভাবে অতীতে পাঠিয়েছি। আমি আগে থেকেই সব জানতাম, তবুও আটকাতে পারিনি। যেটা হওয়ার ছিল সেটা হয়েছেই। তবে চেষ্টা যে করিনি, তা কিন্তু নয়। নিজের জন্মদাতাকে মারতে আমি লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা বারবার ব্যর্থ হই, তখনই বুঝেছি যা হবার তা হবেই। কারণ আমার অস্তিত্ব অলরেডি এসে গেছে। তবে এখনও আফসোস হয় নিজের এরকম একটা জীবনের জন্য নিজেই পরোক্ষভাবে দায়ী। সেদিন যদি কোনোভাবে তোমাকে রুখতে পারতাম তবে হয়তো আমার জন্ম হতো না।’

‘প্রকৃতি আমার সাথেই এই খেলাটা খেলেছে।’ বলে ওঠে রিহান। ‘সবকিছুই প্রকৃতি করেছে। ওই সময় চট্টগ্রাম থেকে ফেরার জন্য বাসস্টপে যেতে চেয়েছিলাম। কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। একটা অদ্ভুত ধরনের লোকাল বাস পেয়ে ওটাতেই উঠে পড়ি। এই বাসটাকে আমি অতীতেও দেখেছি ১৯৪৩ সালে। ওই বাসেই জার্মান সেনারা আমাকে আটকে রেখেছিল। ওই বাসেই সুফিয়া আমাকে গলা কেটে দিয়েছিল। বাসটাই এ সবকিছুর কারণ। অথবা প্রকৃতি হয়তো চেয়েছে আমার সাথে সুফিয়ার এভাবে মিলন হোক, আবার এভাবেই হোক বিচ্ছেদ। প্রকৃতি যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই হয়তো আমাদের জীবন এগোচ্ছে। প্রকৃতিই চেয়েছে আমাদের বাপছেলের মাঝে একটা দূরত্ব হোক। তাই আজ দুজন এভাবে পাশাপাশি বসা স্বত্তেও মাঝখানে অনেকটা দূরত্ব। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। কিন্তু মনে একটা শান্তি লাগছে এইভেবে যে, সেদিন আমার সুফিয়া জার্মানদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল। আমার গলা কেটে সে পালিয়েছিল। তখন থেকেই আমার ভয়, সুফিয়া ধরা পড়লো না তো! আজ নিশ্চিত হলাম। সে ধরা পড়েনি, ধরা পড়লে আমারই সন্তান আজ আমার পাশে বসে থাকতো না।’

‘হুমম, সেদিন মা ধরা পড়েনি। জার্মানরা তাকে অনেক খুঁজেছিল, পুরো বন-এলাকাটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল। জানো, মা সেদিন কী করেছে?’

‘কী?’

‘একটা জার্মানকেও প্রাণে ফিরতে দেয়নি, যেভাবে একদিন তুমি ব্রিটিশ মেরেছিলে।’

‘আমার সুফিয়া? সুফিয়া এমন সাহস দেখিয়েছে?’ আনমনে হেসে ওঠলো রিহান। অবশ্য সুফিয়া যে সাহসী মেয়ে তা খুব ভালো করেই জানে সে।

‘হুমম, মা এমনটাই করেছে।’ বলে ওঠলো ইউসুফ সাহেব। ‘কিন্তু সেদিন মা তোমার গলা কেটেছিল কেন জানো?’

‘কেন?’

‘মায়ের বিশ্বাস ছিল, যার জন্ম ভবিষ্যতে, সে কখনও অতীতে এসে মরবে না। যেভাবে তুমি অতীতে গিয়েছ, সেভাবেই হয়তো ফিরে আসতে পারবে। মা রিস্কটুকু নিয়েছিল, রিস্কটুকু না নিলে তোমাকেও হয়তো সেদিন বাঁচাতে পারতো না, নিজেও ওদের হাতে ধরা পড়তো।’

‘আমার সুফিয়ার অনেক বুদ্ধি ছিল। বুদ্ধিমতী মেয়ে সে।’ অন্যমনস্ক হয়ে বললো রিহান। কেন জানি সুফিয়ার প্রশংসা শুনতে খুবই ভালো লাগছিল রিহানের।

ক্লিনিকে অনেকগুলো পাগলের মাঝে শান্তাও একজন। তবে বাকি পাগলদের সাথে তার পার্থক্য হচ্ছে, বাকিদের চিকিৎসা চলছে সুস্থ করার জন্য, অনেকেই সুস্থ হওয়ার পথে, কিন্তু শান্তার কোনো চিকিৎসা চলছে না ওখানে। সে ধীরে ধীরে তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ডাক্তার শহিদ তার সামনে বসে আছে। শহিদের সমস্ত রাগ এখন শান্তার উপর। শান্তা প্যারালাইজড রোগীর মতো তাকিয়ে আছে শহিদের দিকে। আর শহীদ তার চিবুকটা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ভেতরের রাগটা মেটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ‘কেন শান্তা, কেন এমনটা করলে? তুমি তো জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি, তোমাকে ভালোও বাসি। একটা সময় হয়তো আমাদের বিয়ে হতো। কিন্তু এখন? কী করলে তুমি? তুমি যাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেলে, তুমি জানো সে কে? সে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকলে আমার কত বড়ো ক্ষতি হবে তা কি তুমি জানো? আমার ক্ষতি মানে তো তোমারও ক্ষতি। কারণ, আমরা একসাথে একটা সুন্দর সংসার করতে চেয়েছিলাম। তা আর হলো না। থাকো তুমি এভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে।’

শান্তা নিষ্পলক চোখে অসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল। জবাব দিলো না কিছুই। শহিদ তার চিবুকটা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বললো, ‘পৃথিবীতে আমার একটাই ভয় ছিল, তা হচ্ছে ওই লোকটা। আমি শুধু ভাবতাম, লোকটা যেন কখনও আমার সামনে এসে না পড়ে। যদি এসেই যায় তবে তাকে আমি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিবো না, নয়তো মেরে ফেলবো। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না আমি। লোকটা আমার হাতের নাগালে চলে এসেছিল, কিন্তু তুমি তাকে বাঁচিয়ে দিলে। কেন?’ চিৎকার করে ওঠলো শহিদ। রাগে শান্তার দুগালে কয়েকটা চড় দিলো। শান্তা এবার হেসে ওঠলো। যেন শহিদ তার সাথে মজার কোনো খেলা খেলছে, আর সে খুব মজা পেয়েছে। শহিদ শান্তার মোবাইলটা বের করলো। তারপর ডায়াল নাম্বারগুলো চেক করলো। শেষে যে নাম্বারটাতে কল করেছিল সে, তা ইংরেজি বর্ণে ইউসুফ আঙ্কেল নামে সেভ করা। কয়েকমুহূর্ত কী যেন ভেবে ডায়াল করলো শহিদ নাম্বারটাতে।

গাড়ির ভেতর ইউসুফ সাহেব এবং রিহান তখনও কথা বলছিল। হঠাৎ ফোন বাজতেই ফোনের স্ক্রিনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে তিনি রিহানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শান্তা ফোন করেছে।’

‘রিসিভ করেন।’

ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকার দিলেন ইউসুফ সাহেব। ওপাশ থেকে শোনা গেল, ‘হ্যালো বাবা, কেমন আছো? অনেকদিন পর…’

‘শহিদ?’ অস্ফুটে শব্দ করলেন ইউসুফ সাহেব।

‘হ্যাঁ, নিজের ছেলের কণ্ঠ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছ?’

‘ভুলিনি। শান্তার ফোন তোমার হাতে কেন? ও কোথায়?’

‘আছে আমার পাশে। বোবার মতো চেয়ে আছে আমার দিকে।’

‘বাবা হিসেবে তোমাকে অনুরোধ করছি শহিদ, মেয়েটার কোনো ক্ষতি করো না।’

‘ওর ক্ষতি করবো না। তবে একটা শর্তে। শান্তা শেষবার তোমাকে কল করেছিল। রিহানকে নিশ্চয়ই তুমি সাহায্য করেছিলে তখন। রিহানকে আমার হাতে তুলে দাও।’

রিহানের দিকে তাকালেন ইউসুফ সাহেব। রিহান চোখের ইশারায় সায় দিলো। তখন ইউসুফ সাহেব বললেন, ‘বেশ, তুলে দিবো রিহানকে তোমার হাতে। মেয়েটাকে সুস্থ করে তুলো।’

ফোন কেটে গেল। রিহান অবাক চোখে তাকায় ইউসুফ সাহেবের দিকে। ‘ডাক্তার শহিদ আপনার ছেলে?’

‘হ্যাঁ, আমারই ছেলে। তবে আমার সাথে সম্পর্ক রাখেনি। তবুও ছেলে তো আমার। তাই মাঝেমধ্যে শান্তার কাছে ফোন দিয়ে ওর খোঁজ খবর রাখতাম। ছেলে আমার ডাক্তার হিসেবে খুবই ভালো, নামকরা ডাক্তার। তাই ওর কাছেই তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ও কেন যে তোমার সাথে এমনটা করলো! ও নিশ্চয়ই কোনোভাবে তোমার পরিচয় জেনে ফেলেছে।’

‘হ্যাঁ, ওর কাছে আমি আমাদের গল্প বলেছিলাম, কীভাবে আমি অতীতে গিয়ে সুফিয়ার সাথে পরিচয় হয়, বিয়ে হয় এসব।’

‘যে গল্পটা শুনতে শুনতে ও বড়ো হয়েছে, সেই গল্পটাই তুমি ওর সামনে বললে? সে তো তোমাকেই খুঁজছে।’

‘আমাকে? কেন?’

‘কারণ, আমার মা অর্ধেক সম্পত্তি তোমার নামে উইল করে রেখেছে, এটা সে মানতে পারেনি।’

‘সম্পর্কে শহিদ আমার নাতি। আমি চাই না আমার প্রতি তার রাগ থাকুক। সম্পত্তির প্রতি আমার লোভ নেই। সে ভালো থাকুক।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রিহান। তার জীবনে ওই বিশ মিনিট সময়টা যদি কোনো দুঃস্বপ্ন হয়ে উড়ে যেত। ওই বিশটা মিনিট এতগুলো মানুষের জীবন উলটপালট করে দিয়েছে।

‘অতীত থেকে ফিরে কখনও তোমার সুফিয়াকে খোঁজার চেষ্টা করোনি?’ প্রশ্ন করেন হঠাৎ ইউসুফ সাহেব।

‘খুঁজেছি অনেক। গফরগাঁওয়ে তাদের ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম, ওখানে কেউ তাকে চিনে না। ওই বাড়িটাও নেই ওখানে। ওর দাদুবাড়িতে খোঁজ করেও পাইনি।’

‘মা এখনও বেঁচে আছে জানো?’ রিহানের চোখের দিকে তাকায় ইউসুফ সাহেব। রিহান চমকে উঠে কথাটি শুনে।

‘সুফিয়া এখনও বেঁচে আছে?’ মুখটা হা হয়ে যায় রিহানের।

‘হুমম…’ মাথা দোলায় ইউসুফ সাহেব। ‘এখনও বেঁচে আছে মা, তোমার সাথে শেষবার কথা না বললে হয়তো মরবেও না।’

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here