চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ৯

চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ৯

আমি একদম মন থেকে চেষ্টা করলাম মিতাভাইকে এড়িয়ে থাকতে। এটা এমন কোনো কঠিন কাজ না। বরং তার চোখে পড়াই তুলনামূলক কঠিন। আর এখন লজ্জায় আমি তার সামনে এমনিতেও যেতে পারতাম না। মিজাভাইর কথায় আমার মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি এসেছে। নিজেকে ছোট করে ভালোবাসা পাওয়া যায়না। আমি ভেবেছিলাম সিনেমার নায়িকাদের মতো নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করলে হয়তো তার কৃপাদৃষ্টি পাবো। ঠিক, হয়তো ধীরে ধীরে একদিন আমাকে তিনি কৃপাই করতেন। কত কত মেয়ে এইরকম কৃপা, দয়া আর ভালো না বাসা ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকে। এখন মিতাভাইর জন্য মনের ভিতর ছটফটানির সাথে সাথে এটাও দোলা দিয়ে যাচ্ছে, আমার এই এতোখানি ভালোবাসার ভাগিদার আসলেই তিনি না! এতো ভালোবেসেও যখন তাকে পেলাম না, অল্প ভালোবাসাতেও তো পেতাম না। তাহলে অল্প করে ভালোবাসাটাই যুক্তিযুক্ত। দুই সমীকরণেই তো ফলাফল শূন্য! তবে অল্প ভালো কিভাবে ভালোবাসা যায় আমি জানিনা, যে মানুষের ভাবনা সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে রাখে,দুম করে তাকে ছাড়া অন্যকিছুও তো ভাবা সম্ভব না। তাই আমি তার সামনে যাওয়াটা ছেড়ে দিলাম। বিয়েবাড়িতে তাকে এড়ানো সম্ভব না পুরোপুরি, আমি তাকে না দেখার ভাব করলাম, সবকিছুতে বেশি বেশি ব্যস্ত হয়ে গেলাম। পিউ আপার গায়ে হলুদের কস্টিউম কালার কমলা-সবুজ। সব মেয়েরা কমলা রঙ আর ছেলেরা পরবে সবুজ। হালকা সবুজ রঙের জমিনে গুটিসাদা ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরে মিতাভাই যখন ছাদে এলো আমি নিজের অবাধ্য মনকে হাজাররকম করে বুঝালাম, এই মিফতাহুল ইসলাম নামে দুনিয়ায় কেউ নেই। সে আমার কেউ না। তাকে আমি দেখিনি। এতে কাজ হলো না ঠিকই তবে অনেকদিন পরে মিতাভাইকে বাদ দিয়ে রেখে আমি অনেক আনন্দ করলাম। বহুদিন পরে গলাছেড়ে গান গাইলাম।

“কেন আনো ফুলোডোর
আজি বিদায়ও বেলা
মোছো মোছো আঁখিলোর
যোগী ভাঙ্গিলো মেলা

কেন মেঘেরো স্বপন
আনো মরূরও চোখে
ভুলে দিও না কুসুম
যারে দিয়েছো হেলা”

*****

পিউ আপা চলে যাওয়ার সময় আমার বুক ভেঙে কান্না পেলো। আমার এই বোকা বোকা আপাটা আমাকে বুঝত না কিন্তু দূরে সরিয়েও দেয়নি অন্য সবার মতো। সব কঠিন কঠিন উপদেশ আর আমার শুভ আকাঙ্ক্ষার চাপে ওই ছিলো আমার জানালার খড়খড়ি। আর কেউ আমাকে এতোটুকু বুঝতে পারেনা, চেষ্টাও করে না। মিজাভাই এতো এতো বুদ্ধি দিলো সেও লাপাত্তা। এইযে মিতাভাইর সামনে তিনদিন আমি যাইনি, মিতাভাই তাতেও আমাকে খোঁজেনি একটুও সেই কথা বলতে গিয়েছিলাম যেই, আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালো মিজাভাই আর বলল ‘আমি কি তোর গডফাদার ছুটি, যে সারাদিন তুই কী করবি না করবি তোকে বলে দেবো? তোর যা ইচ্ছে হবে, যা ভালো মনে হবে তাই করবি। ইচ্ছে হলে বেড়ালের মতো লাথি খেয়ে, ঘুরেফিরে আবার কোলে উঠে মিউমিউ করার চেষ্টা করবি, ছলছল চোখে তাকিয়ে মন কাড়ার চেষ্টা করবি। আর যদি ইচ্ছে হয় তো ঘুরে দাঁড়াবি। তাকে এবং নিজেকে সময় দিবি। এক সপ্তাহে হয়নি, একমাস দেখ। হয়তো অনেক কঠিন কিন্তু অসম্ভব তো না! চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে। এখন চেষ্টা করবি নাকি করবি না, সেটা তোর ব্যাপার। ভাগ!’

আমি চেষ্টা করব। সত্যি সত্যি চেষ্টা করব। ভীষণভাবে চেষ্টা করব। প্রতিজ্ঞা করলাম নিজের কাছেই। প্রতিটা নিঃশ্বাসে যার নাম জপি আমি তাকে ভুলে থাকা অনেক কষ্টের তবুও আমি প্রাণান্তকর চেষ্টা করলাম। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় রাতে। বুবু আর আমি এক খাটে ঘুমাই। বুবু ঘুমিয়ে গেলে আমি নিচে নেমে আসি। হাত পেতে ফ্লোরে শুই। মুখে ওড়নার কোণা গুঁজে দিয়ে কাঁদি। আমার কান্না সবার হাসির খোরাক এখন, তাই কান্না গোপন করি আমি। দিনে মায়ের সব কাজে হাত লাগাই। আলমারি খুলে মেলে নিয়ে বসি, নতুন করে পাট পাট করে গুছিয়ে দেই। বারান্দা মোড়া গাছগুলোকে অচেনা লাগে, ত্যানা ভিজিয়ে একটা একটা একটা পাতার ধুলো মুছে দিই।

পিউ আপা চলে যাওয়ার তিনদিনের মাথায় মিতাভাই ফোন দিলো। আমি বিকেলের শেষে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে ধরফর করে উঠলাম। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখলাম কিছু সময়, আজব আজব লাগছিলো। আমার সাথে স্বাভাবিক কথা বলাওতো মিতাভাই বন্ধ করেছে অনেকদিন। সেই ফার্মগেটের ঘটনার পরে কঠিন মুখ সহজ হয়েছিল, আমার প্রতি বিরক্তিতে পড়া কপালের ভাঁজ সংখ্যায় কমেছিলো, কিন্তু ফোন সে কোনোদিনও আমায় করেনি। করবেই বা কেন, আমি তো সবসময়ই চোখের সামনেই থাকতাম, সে যতটা সময় বাড়িতে আমি চোখের আড়াল হতাম না কখনোই। আজ কতগুলো রাত তাকে দেখি না, আদর করি না! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! আমাকে মরণে ধরেছিলো, আমি তাকে সিডিউস করতে গিয়েছিলাম। তাতে তাকে তো পেলামই না, উলটো রাতের বেলা তার অজান্তে তার যে সান্নিধ্যটুকু পেতাম তাও হারালাম!

ফোনটা রিসিভ করে কানে ছোঁয়ালাম।

‘হ্যালো ছুটি?’

‘হ্যালো?’

‘কোয়ান্টাম থিওরির একটা বই ছিলো শেলফে, হলুদ কাভার। বইটা পাচ্ছিনা।’

ওহ, বই? এইজন্য ফোন করেছে আমায়? ধুর! মেজাজ খারাপ করে ফোনটা ছুঁড়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম আমি। শুয়ে শুয়েই খেয়াল করলাম এই প্রথম আমি মিতাভাইর কথা মন দিয়ে শুনলাম না আমি। মোবাইল না আস্ত মানুষটাকেই ছুঁড়ে দিয়েছি বলে মনে হলো আমার। আর এটা আমাকে খুব ভালো অনুভূতি দিলো। এতোদিনের পাওয়া অবহেলাগুলো চোখের উপর ভেসে উঠল আর আমি ছুটি তার উচিত জবাব দিতে চাইলাম। লাফ দিয়ে উঠে আয়নায় দাঁড়ালাম। খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম নিজেকে। এমন কিছু খারাপ না। পিয়া আপা আর আমার বুবুই অতিরিক্ত সুন্দরী। আমাকে এভারেজ বাঙালি মেয়েদের কাতারে ফেলে দেওয়া যায়। গায়ের রঙ ফর্সা হতে গিয়ে সীমানায় আটকে গেছে। লোকে আদর করে উজ্জ্বল শ্যামলা বলে। নাক, চোখ, মুখ আলাদা করে তেমন বৈশিষ্ট্যধারী না, ওইযে বলে না – পটলচেরা চোখ, টিকেলো নাক, এরকম না কিন্তু সব মিলিয়ে আমি সুন্দর। আমার চোখে আমি সুন্দর এটা যেনো মিজাভাইর কথাতেই বুঝলাম আমি। নিজেকে ভালোবাসতে হবে। নিজেকে ভালোবাসার প্রথম ধাপ হচ্ছে, নিজেকে সুন্দর জানা।

এসব ভাবতে ভাবতেও দেখলাম, এইযে আমাকে নিয়ে ভাবছি আমি, তার পেছনেও সূক্ষ্মভাবে মিতাভাইর ভাবনা মিশে আছে। সে আমাকে ভাববে কীনা, ভালোবাসবে কীনা, কবে ভালোবাসবে শুধু তাই ভাবছি। তাকে এড়িয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টায়ও শুধু তার ভাবনায়ই মাথায়।

আমি বুঝতে পারলাম মিতাভাইকে কেন্দ্র করে আমি একজায়গায়ই গোল গোল ঘুরছি। না আগাচ্ছি, না পেছাচ্ছি। আমার জীবনও চড়কির খেলায় আটকে আছে৷ উত্থান পতন আছে, আছে ভীষণ এক্সাইটমেন্ট কিন্তু একজায়গায়ই ঘুরছি।
অভিমান গাঢ় হলো আমার। এর থেকে বেরুতেই হবে আমাকে। আমি তাকে ভাবব না। তার কথা না ভাবতে গিয়েও তাকে আমি ভাবব না। মিজাভাইর সবগুলো কথা মনে আনাগোনা করছে। আসলেই ছুটি চাই আমার। ছোট হোক বা বড়। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকলাম আমার জীবনের প্রায়োরিটি কী কী? উত্তর তো আমি জানিই। মিতাভাই এবং মিতাভাই। তাকে একপাশে সরিয়ে অন্য উত্তরগুলো খুঁজলাম। মিতাভাইর পরে আমি যা ভালোবাসি তা হচ্ছে আমার গান।
একমিনিটের মাথায় সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম কলকাতায় যাবো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেবো। চটজলদি মায়ের কাছে গিয়ে আহ্লাদ করলাম ‘মা আমি কলকাতায় যাবো।’

‘কলকাতা? কেন?’

‘ইচ্ছে করছে মা।’

‘ইচ্ছে করছে বুঝলাম। কিন্তু কেন যাবি? কী করবি গিয়ে?’

‘গান শিখতে যাবো মা!’

‘বোকা নাকি? ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। এখন কোথাও যাওয়া যায় নাকি?’

‘কেন যাবে না? আমি যাবই। আজ যাবো এক্ষুনি যাবো। যাবোই যাবো।’

আমার গলার মরিয়া সুরে মা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালো। তারপরে একইরকম হেলাফেলায় বলল ‘আচ্ছা, মিতাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। সেও যাবে?’

‘কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না, মা। আমি একাই যাবো। আর তুমি কাউকে বোলো না।’

আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল মা। তারপরে আস্তে করে বলল ‘মন ছুটে গেছে যখন, তো যা। তবে এবার একটু বুঝেশুনে।’

আমার মনে হলো আমার এই দূরে যাওয়াটাতে মা খুশি হয়েছে, যদিও মুখে কিছু বলল না। আমি দুমদাম যা সামনে পেলাম তাই দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। পিয়া আপার বিয়ের শপিংয়ের জন্য সবার ভিসা করানো ছিলো। আপার হঠাৎ দেশি পণ্যে মন আসায় আর কারো যাওয়া হয়নি। বাবা খুব দ্রুত এয়ার টিকেটের ব্যবস্থা করে ফেললেন। সেইদিন সেইরাতেই কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ঢাকা ছাড়লাম আমি। ঢাকা ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে, আমার ঘরটা ছেড়ে, মিতাভাইকে ছেড়ে! খুব কষ্ট হলো আমার, অনেক কাঁদলাম!

*****

বাবা আর আমি কলকাতায় খুব আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল, রেসকোর্স, ফোর্ট উইলিয়াম, হাওড়া ব্রিজ, ইডেন গার্ডেন, কলেস স্ট্রিট, কফি হাউজ – যা যা বইয়ে পড়েছি সব একে একে ঘুরলাম বাবার সাথে। আমার হুঁশ হলো। আমার চিন্তায় বাবার কপালের ভাঁজটা আমি এতোদিন পরে দেখতে পেলাম। আমি যে অস্বাভাবিক আচরণ করেছি, সেটা এখন আমার হাসিখুশি বাবাকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম। আমি যে ভালো নেই এটা বুঝতে পেরেই যেনো বাবা, মা আমার সব ইচ্ছে-পূরণ করার চেষ্টায় মেতেছেন। আমার এই প্রথম মনে হতে লাগল, মিতাভাই ছাড়াও আমার একটা পৃথিবী আছে। আর সেই পৃথিবীতে আমাকে ভালোবাসার মতো অনেক মানুষ আছে, আমাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো অনেক প্রিয়জন আছে, যারা আমাকেও প্রিয়জন ভাবে!

মনের ভেতর অনেক রকম চিন্তাই চলে, কখনও আর কখনো মিতাভাইকে ভাবব না ভাবি, তাকে আর ভালোবাসব না দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই, কিন্তু তার চিন্তাও সমান স্রোতে মনের সমস্তটা ভাসিয়ে বয়ে চলে। আমি কিছুতেই স্থির হতে পারিনা। অসহ্য হতে থাকে চারপাশ। ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখব বলে ইন্দ্রাণী দিদিমণির কাছে গেলাম। দিদিমণি বলে দিলেন এইভাবে হয়না। সঙ্গীত সাধনা। তাকে গলায় বাঁধতে গেলে তাকে ভালোবেসেই বাঁধতে হয়, অন্য পিছুটান থেকে মুক্তি পেতে গান শেখা যায়না। অন্তত তিনবছর তার কাছ থেকে তালিম নেওয়ার সময় থাকলেই তিনি আমাকে শেখাবেন। কথাটা মনে ধরল। ভাবলাম এইদেশেই থেকে যাই। আর মিতাভাইর কাছে ফিরবই না। বাবাকে জানালাম। মাকে জানালাম। কেউই আমার সিদ্ধান্তে আপত্তি করল না। মা তো অনেক আগে থেকেই চায়, আমি ওই সম্পর্ক, ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। শুধু মা না, হয়তো সবাই চায়। সবাই! মিতাভাইও।

আমি মিজাভাইকে ফোন দেই। সে আগের মতোই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে কথা বলে।

‘আমি কী করব, মিজাভাই?’

‘তুই কী করবি তা আমি বলে দেব? আমি কী তোর মেন্টর নাকি রে? ফাজিল মেয়ে।’

‘মিজাভাই, আমি এই দেশে থেকে গান শিখি?’ আমতা আমতা করে বললাম।

‘ঠিক হবে ছুটি। এই মিতাভাই দূর হবে আর আমরা পাবো নতুন গানের পাখি ফিরোজা বেগম। থেকে যা ওখানে। আমরা পাগল ছুটির থেকে বেঁচে যাই। এমনিতেই কাপড়চোপড় খুলে বেড়াস, বলা যায়না তো, বদ্ধউন্মাদ হয়ে কোনদিন কামড়টামড় দিয়ে বসিস। পেটের নিচে চৌদ্দটা সুঁই ঢোকাতে হবে তখন।’

‘আমি কি কুকুর, মিজাভাই?’ কান্নায় গলারোধ হয়ে আসে আমার।

‘তা নয়তো কী? এমনভাবে লাথি খেয়ে খেয়েও কুঁইকুঁই করে ফিরে আসিস, তুই তো হাইড্রোফোবিয়ার কুকুর। তুই কামড়ালে চৌদ্দ দুগুনে আঠাশটা ইঞ্জেকশন নিতে হবে।’

‘মিজাভাই?’

‘তবে ছুটি, পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াটা কি উচিত হবে? ধর পড়লি আবার এই দেশেই কারো কাছে গান সাধলি। মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তুই আর মিতাভাইর দয়ায় চান্স পাসনি। উদ্দেশ্য যাই হোক, নিজে পড়েই তো পেয়েছিস। সবাই তোকে হেরো বলবে না? নিজের মনের উপর জোর নেই বলে পালিয়েছিস বলবে না? ধর আর একবছর আমরা দেখলাম? বুঝে দেখ কিন্তু! পৃথিবীতে মেয়েদের মনের জোর অনেক বেশি বলেই পরীক্ষিত সত্য। এইজন্যই দেখিসনা বরেরা মরে যায় তাড়াতাড়ি, আর কুটনি বউগুলো বেঁচে থাকে বহুদিন!’

‘এইসব কী বলেন আপনি মিজাভাই? মেয়েরা কী এতোই খারাপ?’

‘তোকে আপন মনে করে বলিরে! বাইরে বললে তো নারীবাদীরা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো এতোদিনে।’

আমি সব বুঝি। না বোঝার মতো এতোটাও ছোটো না আমি। এতোটাও অবুঝ না। শুধু মনকে বোঝাতে পারি না। মিজাভাই আমাকে বকে। বকে সে প্রমাণ করতে চায় যে সে আমাকে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না। আমাকে উপদেশ দিচ্ছে না। এভাবেই সঠিক সিদ্ধান্তটাই ও আমাকে দিয়েই নিইয়ে দেয়।

মিতাভাইকে এড়িয়ে চলেই পড়াশোনা করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম তিনমাস পর। এই তিনমাসের দীর্ঘ অদেখায় সম্পর্কগুলো নতুন করে আমার চোখে ধরা পড়ল। মা, বাবা, বুবু, বড়চাচা, পিয়া আপা, মিজাভাই এতো কেয়ার করে আমাকে, আমি কেন শুধু মিতাভাইর ভালবাসার জন্য কাঙালিনী হয়ে থাকব? নতুন উপলব্ধি হলো আমার। তবুও মিতাভাই যে বাড়িতে থাকে সেই একই বাড়িতে থাকাটা ঠিক মনে হলো না। মনটাকে যতটা শক্ত করেই না শাসন করি, মিতাভাইর সামনে যে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ব তা বেশ জানি আমি। আবার দুর্বল ছুটি হয়ে যাব।

যাতায়াতের সমস্যা দেখিয়ে আমি হলে উঠে গেলাম। প্রাণপণে ভুলে থাকতে লাগলাম, মিতাভাইকে, আমার বিয়েটাকে। পড়াশোনা চুটিয়ে করতে লাগলাম, গান শেখা হলো না, কিন্তু গান গাইতে থাকলাম সব অনুষ্ঠানে। ভার্সিটিতে আমার একটা পরিচয়ই আছে এখন আলাদা করে, ‘নজরুলের গান গাওয়া মেয়েটা।’

বাড়িতে প্রায় যাইই না। ইদে না গেলে চলে না। অজুহাত খাটানো যায় না। আমি একেকবার একেকটা ট্রিপ নিতে শুরু করি। প্রতি ছুটিতে আমি সমুদ্রে যাই, পাহাড়ে যাই, দূর গ্রামে বান্ধবীর বাড়ি যাই। কলকাতায় ইন্দ্রাণী দিদিমণির বকুনি শুনতে যাই।

মা বাবা আর আর সবাই জানেবোঝে সব। আমার সাথে সাথে তারাও নিজেদের ভুল নিয়ে পস্তায়। আমাকে কেউ আর তাই কিছু বলে না। নয়মাসে আঠারোমাসে বাড়িতে গেলে কোনো কোনোবার মিতাভাইর সাথে দেখা হয়, কোনোবার হয়না। আমি আমার মতো যাই, সে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি শোবার ঘরে লুকিয়ে পড়ি। একবার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম, আমি তিনতলা থেকে নামছিলাম, একটা পার্সেল এসেছিলো সেটা রিসিভ করতে। মিতাভাই মনে হয় ভার্সিটি থেকে ফিরেছেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায় তাই আমিও দাঁড়িয়ে লম্বা করে একটা সালাম দিয়েছিলাম।
‘আসসালামু আলাইকুম মিতাভাই।’

‘ছুটি? কিরে এতোরাতে কোথায় যাচ্ছিস? তোকে খুঁজছি আমি। ডানা গজিয়েছে নাকি? ঘরে থাকছিস না। ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস শুধু?’

‘ঠিক বলেছেন মিতাভাই। দুইটা পাখা পেয়েছি৷ ঘরের ভিতর দম আটকে আসে আমার। বাইরে কত বড় পৃথিবী। সব দেখতে ইচ্ছে করে।’ বলেই তাকে রেখে নেমে গিয়েছিলাম।

মিতাভাই দুবার ফোন করেছিল। আমি তাকে ব্লকলিস্টে নিলাম। একবার উপরে এসেছিলো, আমাকে নাকি খুঁজছিলো। মা বলে দিয়েছে আমি হলে। সে নাকি খুব অবাক হয়েছিলো। ভুঁরু কুঁচকে বলেছিলো ‘আমাকে বলল না?’

আমি জানি হয়তো সরি বলবে। তার দুঃখ প্রকাশের অপেক্ষায় নেই আমি। আমার পুরো জীবনটাই আমি একটা সরি বানিয়ে ফেলেছি। একটা সরি বলে যদি আগের জীবনে ফিরে যাওয়া যেতো, মিতাভাইকে বিয়ে করার মতো ভুলটা আমি আর করতাম না।

দুতিনবার হলের গেইটে দেখা হয়ে গেছে তার সাথে, ক্যাম্পাসেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। তিনি শিক্ষক, আমি এই ভার্সিটিরই ছাত্রি, তার ছাত্রী না হই সম্পর্কটা ছাত্র-শিক্ষকের, সেইভাবে দুটো কথা বলেছি। উনি একবার পেছন থেকে ডেকেছিলেন, আমি ফিরে তাকাইনি। তার একটা সরি আমি শুনবই না। ভয় হয় একটা সরিতেই যদি শক্ত আমার খোলস ভেঙে নড়বড়ে ছুটিটা বেরিয়ে আসে?

বেলা গড়িয়ে রাত হয়, এক এক করে কয়েকটা বছর কেটে গেলো। প্রায় চারবছর। আমি ছুটিছাটায় বাড়ি তো খুব কম যাই। মা আসে, বাবা আসে, বুবুও এসেছে কয়েকবার। পিয়া আপা আসে। বড়চাচা আসে প্রায় প্রতিদিন। পরীক্ষার আগে আগে একটা করে ডাব হাতে করে নিয়ে আসে। মিজাভাইতো ময়মনসিংহ মেডিকেলে আছে। ঢাকা এলেই আমার সাথে দেখা করতে আসে। ক্যাম্পাসে মিতাভাইকে দূর থেকে এক ঝলক দেখলেই বুকের ভেতরটা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে, বাড়িতে বসে তার সামনে দাঁড়িয়ে গুড়িয়ে যাওয়ার সাহস আমার নেই।

এর ভিতর বুবুর বিয়ে। এবারে বাড়ি যেতেই হবে। আমি যাবোও। পুরোনো হিসেবটা এবারে ঝেড়ে ফেলতে হবে, সম্পর্কটাও।

*****

জাবির হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। টিএসসির সবুজ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে আমার জীবনের খাতাটা খুলে একটা একটা পাতা পড়ে শোনালাম ওকে। ও তৈরি ছিলো না এসব শোনার জন্য। আজ ক্যাম্পাসে আমাদের শেষদিন, ও এসেছিল আমার প্রতি ওর অনুভূতি আমাকে শোনাতে। কিন্তু আমি তো তা জানি। আমিতো প্রতিদিনই জাবিরের চোখে আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাই! বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে ও বলল ‘তারপর? তুই বিবাহিত?’

‘বিবাহিত? শব্দটা আমার সাথে যায়না। কেমন জানি লাগে। অনভ্যাসেই হয়তো।’

‘এবার কি করবি?’

‘ইচ্ছে হলে বাড়ি না যেতেই পারি। মা বাবা আমাকে নিয়ে বাইরে থাকতে পারে। কিন্তু এবার আমি বাড়ি যাবো। জীবনের পরীক্ষায় প্রস্তুতি কেমন নিলাম এই চারবছরে সেটা দেখতে যাবো।’

‘তোর বর তোকে কখনো ডাকেনি? কাছে আসেনি কখনো?’

‘কে মিতাভাই? সে হয়তো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আমার প্রেম তার জন্য সত্যিকার অর্থেই কাঁঠালের আঠা ছিলো। এতো সহজে ছেড়ে যাবে বোঝেইনি।’

‘আর আমি? আমাকে কিছু বল?’ জাবিরের চোখে মিনতি।

‘আমি তোকে নিয়ে কখনো কিছু ভাবিনি জাবির। একটা সম্পর্কে থেকে কি আরেকটা সম্পর্কের কথা ভাবাটা ঠিক কখনো?’

‘আর তাকে নিয়ে ভাববি এখনো?’

‘আসলে আমি কখনো তাকে নিয়ে ভাবাটা ছাড়িইনি! তবে এবার তাকে মুক্তি দেবো। এতোদিন ছুটি দিয়েছি, এবারে মুক্তি দেবো। নিজেকেও।’

‘তারপর কী আমার কথা ভাববি? আমাদের কথা?’ রোদের আলো জাবিরের চশমার কাচে, মুখের উপর আলতো গড়িয়ে পড়ছে।

‘জানিনা। আমি আকাশে একটা প্রাসাদ গড়েছিলাম জাবির। মেঘে মেঘেই তা ঝুরঝুর করে পড়ে গেছে। স্বপ্নভঙ্গের জ্বালায় আমি এখনো প্রতিদিন কাঁদি। আমার অনুভূতি একটুও হালকা হয়নি, শুধু সামলে নিতে শিখেছি। আমি একটা ভয়ংকর ভুল করেছি, জাবির। সেই ভুলটা শুধরে নেওয়ার আর কোনো উপায় নেই…’

জাবির একটু কাছাকাছি সরে এলো। আমার বিছোনো শাড়ির আঁচল গুটিয়ে হাতে নিয়ে বলল ‘আমরা সেই ভুলটাকে সাথে নিয়েই নাহয় পথ চলতে শুরু করি…?’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম জাবিরের দিকে। ভরারোদে ওর চোখ ঝিঁকিমিকি করছে। নিপাট ভাঁজ করা ভালোমানুষ চুলগুলো বাতাসে হালকা উড়ছে। ওর চোখে তৃষ্ণা। চাতক পাখি যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, কখন তুমুল বর্ষা নামবে, আর তার পিপাসা মিটবে!

চলবে….

afsana asha
(কপি করা যাবে না)

(সুপ্রিয় পাঠক, বইমেলা ২০২১ এ এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম বই, প্রেমের উপন্যাস ‘অপ্রেমের রাতগুলো দীর্ঘ হয়’ আমি অত্যন্ত খুশি যে আমার পাঠকেরা বইটি এতো আগ্রহে লুফে নিয়েছেন যে ইতিমধ্যে প্রথম মুদ্রন শেষ হয়ে দ্বিতীয় মুদ্রন পাঠকের হাতে পৌঁছে গেছে। অনেক যত্ন আর ভালবাসায় সাজানো আনন্দিতার দেখা পাবেন আমার ওয়ালে, কয়েক পাতা পড়ে নিতে পারেন আর ভালো লাগলে লকডাউনের আগে অর্ডার করে ফেলুন এশিয়া পাবলিকেশন্স, রকমারি, দূরবীন বা বইপরী বুকশপের পেইজে। আমাকেও ইনবক্সে এড্রেস ও ফোন নাম্বার দিতে পারেন। আসন্ন কঠিন সময়ে ঘরে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন আর সময় কাটান আমার ঝিলিক-দিতার সাথে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here